মাঠ থেকে নেট, নেট থেকে আইপিএলের বিস্ময়

‘না স্যার আমি আরও একটা বছর চেষ্টা করে যেতে চাই’। হারিয়ে যেতে বসা মোহিত শর্মা তাঁর কোচ বিজয় যাদবকে ঠিক এ কথাই বলেছিলেন। স্বপ্নের মত এক যাত্রা থেকে হঠাতই ছন্দপতন। একেবারে মহূর্তের মধ্যে তিনি বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সেখান থেকে ফিরে এসে নতুন এক রুপকথা লেখার মঞ্চ সাজিয়ে ফেলেছেন মোহিত শর্মা।

এই তো ক’দিন আগেও তিনি ছিলেন ব্রাত্য। তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) এক মৌসুমের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে জিতেছিলেন আইপিএলের ‘পার্পেল ক্যাপ’। এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা ভারত দলে ছিলেন মোহিত শর্মা।

ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ চূড়াই যেন ছিল সেটি। এরপর ফ্রেটিগস পিরামিডের মত করে সমাপ্তির ঢাল বেয়ে নিচে নেমেছেন মোহিত। পিঠের ইনজুরি আর বাবার মৃত্যু। সব মিলিয়ে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন মোহিত শর্মা। না, পিছিয়ে না একবারে হারিয়ে যেতে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপ খেলা একজন বোলারকে নেট বোলার হওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।

সেই সুযোগটাও হাতছাড়া করেননি মোহিত। আর একটি ক্ষুদ্র সুযোগও যে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে, তারই উদাহরণ সৃষ্টি করলেন মোহিত শর্মা। তবে এর পেছনে কঠোর পরিশ্রম করা মোহিতের গল্পটা জানে না কেউ। তবে তার কোচ বিজয় যাদব জানেন সবটাই।

তিনিই প্রশ্ন করেছিলেন মোহিতকে যে তার ক্রিকেটর প্রতি এতটুকু পরিমাণও তাড়না রয়েছে কি-না। নাকি সে কোচিং-কে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে চায়। সে মুহূর্তেই মোহিত আরও একটি বছর চেষ্টা করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।

এরপর তিনি লেগে যান কঠোর পরিশ্রমে। ২০২০ সালে দিল্লীর হয়ে বাজে সময় কাটানোর পর মোহিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজের ফিটনেসের উপর নজর দেওয়ার। যাদব বলেন, ‘সেই মৌসুমের পর (আইপিএল ২০২০) সে তার বিষয়ে বেশ সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যখনই আমি তাকে ফোন করতাম সে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতো।’

তবে এ সময়ের মাঝেই দৃশ্যপট থেকে একটু একটু করে আবছা হতে থাকেন মোহিত। টানা দুই মৌসুম আইপিএলে নিজেকে প্রমাণের সুযোগটুকু পাননি তিনি। এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটেও তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে দলগুলো। এমন এক পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কথা। তবে মোহিত লড়াই করবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নিলেন।

তবে লড়াই করার থেকেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তার বিস্তৃত মানসিকতা। গুজরাট টাইটান্সের কোচ আশিষ নেহেরা তাকে প্রথমে একজন নেট বোলার হওয়ার প্রস্তাব দেয়। তবে এটাও আশ্বাস দেয় যে কেউ ইনজুরিতে পড়লে তাকে সুযোগ দেওয়া হবে মূল একাদশে। তবে কারও ইনজুরিতে নয়, তিনি সুযোগ পেলেন ইয়াশ দয়ালে পরিবর্তে।

বিশ্বকাপ খেলা একজন খেলোয়াড়ের অভিজ্ঞতাকে অবশেষ দাম দিতে পেরেছে গুজরাট। তবে এই যে বিশাল মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন মোহিত সে বিষয়ে প্রশংসা করেছেন গুজরাট টাইটান্সের অ্যানালিস্ট সন্দীপ রাজু। ঘরোয়া ক্রিকেটে আগে থেকেই মোহিতের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে সন্দীপের। তিনি মোহিতে কোচ বিজয় যাদবের কাছে প্রশংসা করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘বস, আজকালকার ছেলেদের মধ্যে নিজেদের ইগো পেছনে ফেলে এই কাজ (নেট বোলার) করবার।’ আর সেখান থেকেই নিজের ক্যারিয়ারের নতুন লাইফ লাইনে সন্ধান করে নিয়েছেন মোহিত। সুযোগ পেয়েই করেছেন বাজিমাত। হয়েছেন ম্যাচ সেরা। গুজরাটের চিন্তার কারণ কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি।

এই বিষয়ে মোহিত বলেন, ‘আমি এই একটি সুযোগের জন্যে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম, আমি নেট অনুশীলনে যা করি তা মাঠের ক্রিকেটে করে দেখানোর।’ রীতিমত তীর্থের কাকের মত করে তিনি অপেক্ষা করেছেন। নিজেকে শাণ দিয়েছেন। অবশেষে নিজের পরিশ্রমের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

বিশাল মানসিকতা আর পরিশ্রমের আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মোহিত শর্মা। তিনি নিশ্চয়ই এখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে চাইবেন না। যতটুকু সময় হাতে বাকি তার সবটুকুর পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইবেন। ক্রিকেট আকাশের আরও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই শেষ করতে চাইবেন নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সবকিছু সময়ের হাতে তোলা থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link