টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ও অ্যাঙ্করের ভূমিকা

বর্তমান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অ্যাঙ্কর প্রয়োজনীয় কিনা , সেই নিয়ে একটা লম্বা তর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। প্রধানত বিশ্বকাপে ভারতের ভরাডুবি উত্তর। ভারত কি বেশিই এঙ্কর নিয়ে বিশ্বকাপে নেমেছিল? রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি – দুইজন একসাথে কি একটা আদর্শ টি-টোয়েন্টি একাদশে আসতে পারেন? এই নিয়ে একটা ছোট্ট বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম।

অ্যাঙ্কর কাকে বলে, আশা করি সেটা সম্পর্কে প্রায় সকলেই কমবেশি অবগত। তবুও, একবার জানিয়ে রাখি। এমন একজন ব্যাটার যিনি ওপেন করবেন বা তিন নম্বরে আসবেন। একটা দিক ধরে রাখবেন এবং সেট হয়ে গেলে মারবেন। অপর প্রান্তের ব্যাটাররা মন খুলে মারতে পারবেন। উইকেট হারালেও, অপর দিকে একজন ইনিংস ধরে রেখেছেন সেই ভরসায়, যতটা সম্ভব আক্রমণাত্মক খেলবেন।

এবার প্রশ্ন হল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অ্যাঙ্কর কি আদৌ প্রয়োজন? ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ৩০০ বলে ব্যাটিং দলের হাতে থাকে ১০ উইকেট। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩০ বলে একটা উইকেট হারালে একটি দল ৫০ ওভারের শেষে অল-আউট হয়ে যাবে। আবার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রতি ২ ওভারে একটি করে উইকেট হারালে একটি দল ২০ ওভারের শেষে অল-আউট হবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অল-আউট হবার সম্ভাবনা একদিনের ক্রিকেটের চেয়ে অনেক কম।

ঐতিহাসিক ভাবে ডেটা সেই কথাই বলছে। অর্থাৎ, আমরা যদি এভাবে ভাবি, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে উইকেট শেষ হবার চাইতেও বল শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ঠিক এখানেই এঙ্করের যৌক্তিকতা বড়োসড়ো চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। অবশ্যই মাঝে মাঝে কঠিন ব্যাটিং পিচ হলে, অ্যাঙ্কর জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই পিচ হয় পাটা। অবশ্যই এই বিশ্বকাপ কিছুটা ব্যতিক্রম। কিন্তু এক্সেপশন তো নিয়মকেই আরও কঠোর ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। যাই হোক, এবার চলে আসা যাক আঙ্কিক বিশ্লেষণে।

অ্যাঙ্কর মূলত ওপেনার বা তিন নম্বর ব্যাটার হন। তা আমি আমার বিশ্লেষণের সুবিধার্থে, চার জন ব্যাটারের পরিসংখ্যান নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। চারজনই জনপ্রিয় হওয়াতে কেস স্টাডি বোঝাতে সুবিধা হবার কথা। এই চারজন হলেন কোহলি, রোহিত, বাটলার ও ওয়ার্নার। গত দুই বছরে এঁরা যথাক্রমে ২৭, ২৬, ২২ ও ১৮ আন্তর্জাতিক টি-২০ ইনিংস খেলেছেন।

কোহলি করেছেন ৭৪৮ বলে ১০৬০ রান (স্ট্রাইক রেট ১৪১.৭১), রোহিত ৫৫৭ বলে ৮০১ রান স্ট্রাইক রেট ১৪৩.৮১), ওয়ার্নার ৫৩৯ বলে ৭৬২ রান (স্ট্রাইক রেট ১৪১.৩৭) ও বাটলার ৬০৪ বলে ৮৮০ রান (স্ট্রাইক রেট ১৪৫.৭০) । আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যেকের স্ট্রাইক রেট কাছাকাছি। পষ্টাপষ্টি কাউকে বেছে নেবার উপায় নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে অনেক কিছু দেখা যাবে।

কোহলি এই সময়ে খেলেছেন গড়ে ইনিংস প্রতি ২৮ বল, রোহিত ইনিংস প্রতি ২১ বল, ওয়ার্নার ইনিংস প্রতি ৩০ বল ও বাটলার ইনিংস প্রতি ২৭ বল। কোহলি তাঁর ২৮ ইনিংসের মধ্যে ৫৫.৫৬% ইনিংসে ২৮ বলের কম সময়ে ক্রিজে কাটিয়েছেন। এবং এইসব ইনিংসে (অর্থাৎ যে ইনিংসে ২৮ বলের কম সময় ক্রিজে ছিলেন) তাঁর স্ট্রাইক রেট ১১৮.৯৮। আবার যে ৪৪.৪৪% ইনিংসে তিনি ২৮ বলের বেশি খেলেছেন, তাঁর স্ট্রাইক রেট গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০.৯৪ এ। অর্থাৎ কোহলি ইনিংসের শুরুতে ধীরে ধীরে শুরু করে, আসতে আসতে স্ট্রাইক রেট বাড়িয়েছেন।

কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে অর্ধেকের বেশি ইনিংসে তো তিনি এতক্ষন টিকতেই পারেননি। অর্থাৎ গড়ে পাঁচটি ইনিংসের মোটামুটি তিনটিতেই কোহলির গড় রান দাঁড়াবে ২৮ বলে ৩৩। টি-২০র হিসাবে নিতান্তই সাধারণ। এবং যেটা আরো চিন্তার বিষয় তা হলো, কোহলির এক চতুর্থাংশ রান ১১৮.৯৮ স্ট্রাইক রেটে। রোহিতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো চিন্তার। তিনি এই সময়ে গড়ে ইনিংস প্রতি ২১ বল খেলেছেন। এবং তাঁর ২৬ ইনিংসের ৫৭.৬৯% ইনিংসেই ২১ বলের চেয়ে কম খেলেছেন।

এইসব ইনিংসে রোহিতের স্ট্রাইক রেট ১০২.০৮। অবশ্য একবার টিকে গেলে রোহিত ভয়ঙ্কর। যেসব ইনিংসে ২১ এর বেশি বল তিনি খেলেছেন তাতে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৫৮.৩৫। মানে ওয়ানডের টেমপ্লেটই রোহিত ও কোহলি টি-২০ তে নিয়ে এসেছেন। সমস্যা হচ্ছে, ওয়ানডেতে সময় অনেক বেশি পাওয়া যায়, তাই আসতে আসতে শুরু করেও মোটামুটি বড়ো স্কোর ভালো স্ট্রাইক রেটে নিয়মিত করে যান রোহিত ও কোহলি। টি-টোয়েন্টিতে সেই সুযোগটাই নেই। রোহিত তাঁর ১৮.৩৫% রান করেছেন ১০২.০৮ স্ট্রাইক রেটে। রোহিতেরও এই সময়ে গড়ে প্রতি ৫ ইনিংসের তিনটিতে রান হবে ২১ বলে ২১।

এবার আসা যাক ওয়ার্নার ও বাটলারের পরিসংখ্যানে। আগেই লিখেছি ওয়ার্নার গড়ে ইনিংস প্রতি ৩০ টি বল খেলেন। ওয়ার্নারের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে ভালো ব্যাপার, তা হলো, তিনি ১৮ ইনিংসের মাত্র ৩৮.৮৯% ইনিংসে ৩০ এর কম বল খেলেছেন এবং এইসব ইনিংসে রানের শতাংশ তাঁরই সবচেয়ে কম (এই চারের মধ্যে)-মাত্র ৭.৭৪% । যদিও এইধরণের ইনিংসে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১১৫.৬৯, তবুও তাঁর অসাধারণ ধারাবাহিকতা তাঁকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রাখে। যেসব ইনিংসে তিনি ৩০ এর বেশি বল খেলেছেন, তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৪৪.০৬।

কোহলি ও রোহিতের চেয়ে কিছুটা কম হলেও, ধারাবাহিকতায় পুষিয়ে দিচ্ছেন। আর যেসব ইনিংসে তিনি ৩০ এর কম বল খেলছেন, তাতে বেশি বল নষ্ট না করে আউটও হচ্ছেন খানিক তাড়াতাড়ি। সবশেষে আসি বাটলারের কথায়। বাটলার ইনিংস প্রতি গড়ে ২৭ বল খেলেছেন। যদিও তাঁর ২২ ইনিংসের ৫৪.৫৫% ইনিংসেই তিনি ২৭ এর চেয়ে কম বল খেলেছেন এবং তাঁর ২২.৮৪% রানই এসেছে এইসব ইনিংস থেকে, এই ধরণের ইনিংসে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৩০.৩৬।

এই চারজনের মধ্যে সেরা। আবার যখন গড়ের চেয়ে বেশি বল খেলেছেন তখনও তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৫৫.৩৮-যা এই চারজনের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা। রোহিতের পরেই। এই চারজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বললে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে অন্তত বাটলারকেই আমার দলে চাইবো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে ওয়ানডের টেমপ্লেটে আর কদিন টি-টোয়েন্টি খেলে যাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ।

তবে তাই বলে কি অ্যাঙ্কর রা দলেই থাকবেন না? থাকবেন সুপার-স্পেশালিস্ট হয়ে। পিচ ঘুরলে বা বল নড়লে তাঁদের ডাকা হবে। যদিও এ মতামত আমার একান্তই ব্যক্তিগত। এবং এই লেখার পরে আমি হয়তো কিছু পাঠক হারাতেও পারি। তবুও মনে হলো, লেখাটা থাক। লেখার সাথে এক্সেলের স্ক্রিনশট দিলাম। চাইলে সেটা দেখতে পারেন কিন্তু। আর বাকিটা থাক সময়ের গর্ভেই।

সমস্ত তথ্য ২০১৯ এর পয়লা জানুয়ারি থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হওয়া অবধি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link