টেপ টেনিস থেকে এসে ১৩ উইকেট

তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন নুরুল হাসান সোহান।

একটা দলে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করলেন, ‘ভাই, তানভিরকে নিয়ে নেন। দারুণ বোলার।’

তাই করা হলো। ‘তানভির’কে দলে নেওয়া হলো। টিম লিস্ট দেখে সোহানের মাথায় হাত – এ তো তানভির হায়দার! কর্মকর্তাদের বললেন, ‘আমি তো তানভির হায়দারকে চাইনি। আমি বলছিলাম তানভির ইসলামের কথা।’

তানভির ইসলাম! সে আবার কে!

লোকেরা তো তানভির ইসলামকেই চিনতে পারছে না। লোকেদের আর দোষ কী? আমরাই তো তানভির ইসলামকে ঠিকমতো চিনতে পারছিলাম না। অবশেষে তানভির নিজেই চেনানোর দায়টা নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। চট্টগ্রামে আয়ারল্যান্ড উলভের বিপক্ষে বল হাতে রীতিমতো জাদু দেখালেন। দুই ইনিংসে গুনে গুনে ১৩টা উইকেট তুলে নিলেন। সারা দেশের লোকে জানলো, তানভির ইসলাম নামে নতুন এক বাঁ-হাতি স্পিনার এসেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

তানভির অবশ্য মোটেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন কোনো নাম নন। ২০১৭ সাল থেকে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলছেন বরিশালের হয়ে। একই বছর থেকে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট খেলছেন খেলাঘরের হয়ে। তারও বছর তিনেক আগে থেকে ঢাকার ক্রিকেট খেলছেন।  কিন্তু সেভাবে নজরে ছিলেন না। অবশেষে এই ২৪ বছর বয়সে এসে নজরে এলেন ১৩ উইকেট নিয়ে।

তানভির তার নিজের পারফরম্যান্সে যথারীতি উচ্ছসিত। এই প্রথম জীবনে এক ইনিংসে ৮ উইকেট পাওয়ার আনন্দ তো চেপে রাখার জন্য নয়। তিনি বলছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো লাগছে। এর আগে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৬ উইকেট পেয়েছি। কিন্তু ৮ উইকেট কখনো পাইনি। দোয়া করবেন, এরকম যেনো করে যেতে পারি।’

এরকম পারফরম্যান্স করে যাওয়াটা তানভিরের জন্য খুব জরুরী। কারণ, ক্রিকেটার হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েই এসেছেন তিনি এই ঢাকা নগরীতে।

বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার ছেলে তানভির। গ্রামে টেপ টেনিস খেলে বেড়াতেন। টেনিস বল ঘোরানোটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। সেই বলেই দূরন্ত স্পিন করতেন। নিজের মধ্যে স্বপ্ন ছিলো ক্রিকেটার হওয়ার। সাহস করে বাবাকে বলতে পারছিলেন না।

বাবা থাকেন ঢাকায়। ছুটিতে বাড়ি এলে এলাকার কয়েক জন গিয়ে ধরলেন-আপনার ছেলেকে ক্রিকেটে দিয়ে দেন। বাবা এক বাক্যে ‘না’ করে দিলেন-ক্রিকেট খেলে কিছু হবে না। এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো ক্রিকেটার তানভিরের গল্প।

এই সময় ত্রানকর্তা হয়ে এলেন তানভিরের নানা। তিনি বললেন, ‘ক্রিকেটই যখন ভালোবাসে, ওকে একটা সুযোগ দাও। অন্তত দুটো বছর চেষ্টা করুক। না পারলে আবার বাড়ি ফিরে আসবে।’

সেটা ২০১২ সালের ঘটনা। বাবার সাথে ঢাকায় এলেন তানভির। বাবাই ধরে রায়ের বাজার ক্লাবে ঢুকিয়ে দিলেন। সেখানে তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেললেন তানভির। প্রথম বছরেই সংগঠকদের চোখে পড়ে গেলেন। সেখান থেকে দ্বিতীয় বিভাগের দল খেলাঘর নিয়ে এলো তানভিরকে। এই দলে পাঁচ মৌসুমেই দারুণ সাফল্য পেলেন। আর এই খেলাঘরে তাকে দেখলেন সাবেক টেস্ট তারকা নাফীস ইকবাল।

তানভির বলছিলেন, ‘আমাকে ঢাকায় দু জন মানুষ খুব ব্রেক দিয়েছেন। আমার প্রথম কোচ সাইফুল ইসলাম। উনিই আমার বোলিংয়ের গুরু বলতে পারেন। উনি সব ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। আরেকজন নাফীস ভাই। উনি আমাকে খুলনা টাইটান্সে নিয়ে এলেন।’

বিপিএলে খুব বলার মত পারফরম্যান্স এখনও করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে বরিশালের হয়ে খেলেছেন; কেবল এক ম্যাচে সাকিবের উইকেট নিয়েছিলেন। ঢাকা লিগে অবশ্য নিয়মিত উইকেট শিকার চালিয়ে যাচ্ছেন। ৪৭ ম্যাচে ৭১ উইকেট নিয়েছেন এখন পর্যন্ত লিস্ট-এ ক্রিকেটে। আর প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে এই ম্যাচের আগেই ১২ ম্যাচে শিকার তার ৩২ উইকেট।

আর এসবের পুরষ্কার হিসেবে কিছুদিন ধরেই আছেন হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে। এবার সেরা সুযোগটা পেলেন আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে। প্রথম সুযোগেই জ্বলে উঠলেন। এখন তার সামনে জাতীয় দলের স্বপ্ন।

বাংলাদেশ মানেই বাঁহাতি স্পিনারদের ছড়াছড়ি। এখানে তানভিরের স্বপ্নপূরণের পথটা সোজা হবে না। তবে তানভির চ্যালেঞ্জ নিতে তৈরি। তাই বলে আবার নিজেকে খুব দ্রুত পরের ধাপে দেখার আশাও করছেন না।

 

বলছিলেন, ‘চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। আমি ক্রিকেটার হওয়ার জন্য বাড়ি থেকে এসেছি। জাতীয় দলই তো মূল লক্ষ্য। তবে এক ম্যাচ দিয়ে তো আমাকে কেউ বিচার করবে না। সেটা আশাও করা যাবে না। আমাকে এই পারফরম্যান্স করে যেতে হবে। আমি এখন শুধু এই পারফরম্যান্সটা ধরে রাখতে চাই। রোজ এমন হবে, আশা করি না। তবে ধারাবাহিকভাবে খেলতে হবে।’

তাই হোক। হঠাৎ ফুরোতে থাকা বাংলাদেশের স্পিন ধারায় উঠে আসুক নতুন স্বপ্ন। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের মূল বয়সভিত্তিক ক্রিকেট কাঠামোর বাইরে থেকেও উঠে আসুক দু একটা প্রতিভা। প্রমাণ হোক, দেশের সহজাত প্রতিভার স্রোতেরও জায়গা আছে মূল ধারায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link