লাল বলের কবি

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ – জীবনানন্দের লেখা লাইনটি আমাদের খুবই পরিচিত। আর এই লাইনটি ধার করে বলা যায় – ‘এই ক্রিকেটে এক ব্যাটসম্যান আছে।’ ক্রিকেটে তো কত কত ব্যাটসম্যানই আছে তবু একজনের কথাই কেন?
একজনের কথা বলার কারন তিনি বিশেষ; এই বিশেষ ব্যাটসম্যানের নামই তার বিশেষত্ব বোঝাতে যথেষ্ট। নামটা যে স্টিভ স্মিথ, স্টিভেন পিটার ডেভেরিউক্স স্মিথ।

জীবনানন্দ যেমন বাংলার রূপ দেখে ভুলতে বসেছিলেন পৃথিবীর রূপ তেমনি স্মিথের ব্যাটিং প্রদশর্নী ভুলিয়ে দিতে পারে ক্রিকেটের অন্য দিকগুলো। একেবারে ক্রিকেট ব্যাকরনের সব শট যার আয়ত্তে তার ব্যাটিং উপভোগ করলে আর দেখারও বা বাকি থাকে কি? বল লিভ করার বিরক্তিকর ব্যাপারও তিনি দর্শকদের জন্য বিনোদনে পরিনত করেছেন। ব্যাটিংয়ের সব বৈচিত্র্য আর ভিন্নতা যেন প্রকৃতি সাজিয়ে দিয়েছে স্মিথের ব্যাটে।

শুরুটা লেগ স্পিন দিয়ে, কবজির মোচড়ে ম্যাচের গতিপথ পাল্টে দেয়ার লক্ষ্যেই ক্রিকেটের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন এই অজি ক্রিকেটার। এরপর লেগস্পিনার হিসেবেই এসেছিলেন জাতীয় দলে। এমনকি লোকে তাকে শেন ওয়ার্ন-এর উত্তরসূরীও মনে করা শুরু করেছিলেন। শেন ওয়ার্ন নিজে তাঁকে নিয়ে কিছু কাজও করেছেন। একজন লেগস্পিনার হিসেবে ব্যাটিং অর্ডারের নিচের দিকে ব্যাট করতেন।

কিন্তু কে জানতো শেন ওয়ার্নের উত্তরসূরী হয়ে এসেও একদিন তিনি রিকি পন্টিং এর পদচিহ্ন অনুসরণ করবেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু বলার মতো ইনিংস স্মিথের ছিলো। কিন্তু সেসব ইনিংসকে ছাপিয়ে গেলো জাতীয় দলে এসে স্মিথের ব্যাটিং। নিজের ব্যাটিং দক্ষতা দিয়ে প্রমোশন পেয়ে পেয়ে টপ অর্ডারে চলে এলেন। কালক্রমে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হলেন। এখনও তিনি কবজির জোরে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করেন; তবে বল হাতে নয়, ব্যাট হাতে।

বলা হয়, টেস্ট ক্রিকেটই নাকি আসল ক্রিকেট। তাই যদি সত্য হয়, তবে নিঃসন্দেহে স্টিভ স্মিথ আসল ক্রিকেটের একজন নায়ক কিংবা শিল্পী। সর্বকালের সেরা টেস্ট রেটিংয়ে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা রেটিংধারী ব্যাটসম্যানও হয়েছেন। আধুনিক যুগের টেস্টে সেরা তিনজন ব্যাটসম্যানের একজন স্মিথ হবেন সেটা নিশ্চিতই। রান করেন ফোয়ারার জলের মত, আর সেই জলরাশি’র সৌন্দর্য তো কোন বাক্যে প্রকাশ করা যায় না। হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিতে হয়।

এবার টেস্ট ক্রিকেটে ৮,০০০ বা তার বেশি রান করা খেলোয়াড়দের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন স্টিভ স্মিথ। পাকিস্তান সিরিজের তৃতীয় টেস্টে এই রেকর্ড করেন স্টিভ স্মিথ। তিনি হয়ে গিয়েছেন সপ্তম অজি ব্যাটসম্যান যে এই লাল বলের ক্রিকেটে আট হাজারী ক্লাবের সদস্য হয়েছে। রিকি পন্টিং, অ্যালান বর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, মাইকেল ক্লার্ক, ম্যাথিউ হেডেন এবং মার্ক ওয়াহ তার আগে রয়েছেন সর্বোচ্চ রানের বিচারে।

 

এই রান করতে স্টিভ স্মিথ নিয়েছেন ১৫১টি ইনিংস। আট হাজারী ক্লাবের আর কোন সদস্যই এরচেয়ে দ্রুত এই মাইলফলক স্পর্শ করতে পারে নি। স্মিথের পরেই রয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা; তাকে আট হাজার রান করতে এক ইনিংস বেশি খেলতে হয়েছে। এরপর আছেন শচীন টেন্ডুলকার যিনি ১৫৪ ইনিংস খেলে আট হাজার রান করেছিলেন। এছাড়াও টপ ফাইভে আছেন গারফিল্ড সোবার্স (১৫৭ ইনিংস) এবং রাহুল দ্রাবিড় (১৫৮ ইনিংস)।

লেগি হিসেবে আগমন, এরপর ভরসাযোগ্য একজন ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠা, অজি দলেরও অধিনায়ক হয়েছিলেন। বল টেম্পারিং কাণ্ডের দায়ভার মাথায় নিয়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল স্মিথকে। এত এত ঘটনার মাঝেও কখনো ব্যাটের ধার কমেনি তার। ব্যাটটাই যুগে যুগে একজন ব্যাটসম্যানের সবকিছুর জবাব দেয়ার হাতিয়ার বনেছে। স্টিভ স্মিথের সম্বলও এই উইলোটাই; যতবার সমালোচনা ধেয়ে এসেছে নিজের দিকে ততবারই সেটা আছড়ে ফেলেছেন সীমানা দড়ির ওপাশে।

অ্যাশেজের উপর নির্মিত অ্যামাজন প্রাইমের ডকুমেন্টারিটা আপনাকে দেখায় আউট হওয়ার পর ড্রেসিংরুমে স্মিথের অভিব্যক্তি; ব্যাট, গ্লাভস ছুড়ে ফেলে হতাশায় মুখ ঢেকে ফেলা। সেটা দেখে আপনি মোহাচ্ছন্ন হন, আবার ক্রিকেটের জগতে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন। দলের প্রতি একনিষ্ঠতা আর একাগ্রতার একটা নিদর্শন দেখা যায় সেখানে। খেলাটার প্রতি ভালোবাসা কোথায় গিয়ে ঠেকলে এরকম অভিব্যক্তি আসতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে হলে আপনাকে একজন স্মিথ হতে হবে।

আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম বাদে ভক্তদের কোনো আসরে যদি টেস্ট ক্রিকেট কিংবা ব্যাটিংশৈলী নিয়ে আলোচনা হয়, নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির পাতার মলাট খুলতেই ইতিহাস খুঁজে নেবে স্টিভেন স্মিথকে। স্মিথের রূপকথা স্মৃতিচারণ হবে; প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে যাবে একজন স্টিভ স্মিথের গল্প; বাইশ গজে নিবেদিত এক আত্মার গল্প। আলোচনার পরতে পরতে থাকবে উইলো দিয়ে ক্রিকেটের মাঠে লিখে ফেলা স্টিভ স্মিথের এক অবিশ্বাস্য কাব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link