শেষ ওভারে ১৫ রান প্রয়োজন। আপনি কাকে চান ব্যাটিং প্রান্তে? উত্তরটা তোলা থাক। তবে আপনি নিশ্চয়ই আজকের দিনে ফিনিশার তকমা গায়ে জুড়ে নেওয়া কোন একজন খেলোয়াড়েরই নাম নেবেন সেটা বুঝতে পারাটা নিশ্চয়ই দাবার ঘোরার আড়াই চাল বোঝার থেকেও সহজ। তবে আধুনিক সময়ের এই ‘ফিনিশার’ হওয়ার সংজ্ঞা কি?
একটা সময় ভাবা হত একজন ব্যাটার যিনি কি না শুধু একটা ম্যাচ জিতিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন তিনিই শুধু ফিনিশার। সে সংজ্ঞায় এখন অবধি একজনকেই সেরা ফিনিশার মানা হয়। আর তিনি হচ্ছেন অজি ক্রিকেটার মাইকেল বেভান। তিনি দক্ষ নাবিকের মত দলের জাহাজ জয়ের বন্দরে ভিড়িয়েই শান্ত হতেন। তিনি এই কাজটা যখন নিয়ম করে করতেন তখন এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট আলোর মুখও দেখেনি।
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে পরীক্ষামূলকভাবেই শুধু এই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দেখা মিলত। তখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির ছাত্র টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। সে সময়ই বেভানকে ডাকা হত ফিনিশার হিসেবেই। তিনি যেটা করতেন তা এখনকার ফিনিশারদের কাজের থেকে খানিকটা ভিন্ন। তিনি মূলত ডটবলে পরিমাণ কমিয়ে ক্রমাগত ‘স্ট্রাইক রোটেট’ করতেই ব্যস্ত থাকতেন।
তবে এই আধুনিক সময়ে এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ব্যাপক বিস্তারের ফলে এই ফিনিশারের সংজ্ঞা বদলে গেছে পুরো ৩৬০ ডিগ্রি। এখন শুধুমাত্র ম্যাচ যিনি জিতিয়ে আনেন তাঁকেই শুধু ডাকা হয়না ফিনিশার হিসেবে। যিনি দলের ব্যাটিং ইনিংসের সমাপ্তি ঘটাবেন মারকাটারি ব্যাটিং করে তিনিই ফিনিশার। সেদিক থেকে বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকাদের মধ্যে রয়েছেন ক্যারিবিয়ান খেলোয়াড়েরা। কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেলসহ আরও অনেকে।
ক্যারিবিয়ান ছাড়াও নিউজিল্যান্ডে জিমি নিশাম, ইংল্যান্ডের লিয়াম লিভিংস্টোন, দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার যেমন রয়েছেন। ঠিক তেমনি সহযোগী দেশগুলো থেকে ডেভিড উইসে, টিম ডেভিডের মত খেলোয়াড়ও রয়েছেন। তবে সময়ের সাথে তালিকাটা খানিক বড় হচ্ছে। আর চাহিদাও বাড়ছে এই খেলোয়াড়দের।
যেমন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের এবারের মেগা নিলাম হতে পারে একটা উদাহরণ। লিয়াম লিভিংস্টোনকে পাঞ্জাব কিংস কিনেছে ১১ কোটির বেশি রুপিতে। অন্যদিকে বাকি থাকা এই ফিনিশাল রোলে খেলা খেলোয়াড়রাও বিক্রি হয়েছেন চড়া দামে। এটাই প্রমাণ করে যে আসলে ঠিক কতটা চাহিদা একজন ফিনিশারের।
অথচ একজন ফিনিশার কিন্তু পুরোটা ম্যাচ খেলেন না। তিনি গড় ১০-১২ বল হয়ত খেলার সুযোগ পান। তবে সে ১০-১২ বল ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেয়। ফিনিশাররা সে কাজটা করতে পারেন বলেই তাঁদের কদরটা খানিক বেশি। তবে এই যে নতুন ধারার এই ফিনিশার বনে যাওয়াটা কিন্তু একেবারে সহজ কাজ নয়। এমন নয় যে এলাম আর গায়ের জোরে বল পিটিয়ে মাঠ ছাড়া করলাম।
এর জন্যে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা। তার জন্যে অবশ্যই টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে দলের প্রতিটা খেলোয়াড়কে তাঁদের দলে থাকা ফিনিশারকে বিশ্বাস করা প্রয়োজন। তাঁকে ভরসা জুগিয়ে যেতে হবে। খারাপ সময়ে পাশে থেকে ভুলগুলো শুধরে দেওয়াও জরুরি। সে সাথে খেলোয়াড়টিকে বিশ্বাস করাতে হয় যে তিনি পারবেন। ফিনিশার রোলটায় একজন প্রতিদিন নিয়ম করে ভাল করবেন তেমনটা ভাবা বড্ড বড় বোকামি।
একজন ফিনিশার সাধারণত চাপের মুখেই ব্যাটিং করতেন নামেন। আবার অন্যদিকে উপরের দিকে ব্যাটাররাও খানিকটা ভরসা পান যে তাঁদের দলে একজন বিশ্বমানের ফিনিশার রয়েছেন। সে ভরসা থেকেও উপরের দিকের ব্যাটাররা হাতখুলে খেলে থাকেন। তখন দ্রুত উইকেটের পতনে আবার ফিনিশারদের অন্য এক দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিতে হয়। ইনিংস ধ্বস সামলে নেওয়ার দায়িত্ব।
সে ভিন্ন আলাপ। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের হিসেবে একজন ফিনিশারের প্রধান কাজটাই থাকে গুটিকতক বলের মাঝেই নিজের পেশিশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করে দ্রুত রান তুলে ফেলা। যাতে করে দলের স্কোরবোর্ডটা আরেকটু শক্ত হয়। আর প্রতিপক্ষ বোলারদের উপরও চাপ বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে এসে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষ ওভারে ১০-১৫ রানও মামুলি বিষয়। বোলার যদিনা দারুণ কিছু করে বসেন তাহলে ব্যাটারদের পক্ষে ম্যাচ যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
যদি একজন দক্ষ ফিনিশার থাকেন বাইশ গজে। এই দক্ষতা অর্জনে খুব বেশি কাঠখর পোড়াতে হয় না খেলোয়াড়দের বিষয়টা তেমনও নয়। নিজেদের পেশিশক্তি বাড়াতেও কাজ করতে হয়। সে সাথে নেট অনুশীলনে লম্বা সময়ে ব্যয় করতে হয়। এক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা কাল্পনিক এক ম্যাচ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে অনুশীলন করে থাকেন। যার ফলে তাঁরা আগে থেকেই বিরুপ সব ধরণের পরিস্থিতির জন্যে আগে থেকেই খানিক প্রস্তুতি সেরে রাখেন।
আবার ম্যানেজমেন্টের অনেক হিসেব-নিকেশও কাজ করে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার ব্যাড হজের কথাই চিন্তা করা যাক। আইপিএলে তিনি সাফল্য পেয়েছেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ফিনিশার রোলে। অথচ তিনি ক্যারিয়ারে টপ অর্ডার থেকে মিডল অর্ডার অবধি খেলেছেন। এখানটায় একটা বিষয় কাজ করে। টপ অর্ডারে ব্যাটাররা সাধারণত পেস বোলারদের খেলার সুযোগ পান। ঠিক একই ঘটনা ঘটে ইনিংসে শেষের দিকে।
সাধারণত পেসারদের দিয়ে বোলিং ইনিংসের সমাপ্তি টানেন অধিনায়কেরা। সেদিক বিবেচনায় টপ অর্ডার ব্যাটাররা স্বাভাবিকভাবেই ফিনিশার রোলে ভাল করার কথা। সেদিক থেকে এই ‘গ্যাম্বলিং’ করার আগে টিম ম্যানেজমেন্টকে খুঁজে বের করতে হবে সেই ফিনিশার রোলটা সত্যিকার অর্থেই ভাল করতে পারবে। খুঁজে বের করার পাশপাশি তাঁকে সে মানসিক দৃঢ়তা প্রদান করাও দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের।
সময়ের পরিক্রমায় খেলোয়াড়দের, দলগুলোর চাহিদা বদলে গেছে। আর পাঁচটা রোলের মধ্যে এখন একজন ফিনিশারের রোলটাও ভীষণরকম গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ খেলোয়াড়রাও তাই এই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জৈলুশে নিজেদের আগ্রহের পাত্র বানাতে নিশ্চয়ই এই ফিনিশার রোলটায় নিজেদেরকে দেখতে চাইছে। তবে সে জন্যে নিজেদেরকে মানসিক ও শারীরিকভাবেও গড়ে তোলা প্রয়োজন।
একটা বিপ্লব ঘটে গেছে ক্রিকেটে। সমর্থকদের জন্যে এই বিপ্লবটা বেশ উপভোগ্য। কালের বিবর্তনে আরও নতুন নতুন সব ক্রিকেটীয় শিল্পের সাথে। বিবর্তন, বিপ্লব থেকে বিপর্যয় না হোক।