২১ জুন, ২০০২। দিনটা ছিল শুক্রবার।
বর্ষা মৌসুম, তাই আকাশ মেঘলা ছিল। তবে আগের রাতে ঘুম হয়নি। কারণ পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি শক্তিশালী ইংল্যান্ডের। ব্রাজিলের প্রথম কোন পরাশক্তির মুখোমুখি, তাই অন্যরকম এক উত্তেজনা এবং চাপ কাজ কারছিল। রোনালদো, রিভালদোরা যদি আজকের ম্যাচে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারে তাহলে ফাইনাল নিশ্চিত।
রিভালদোর সাথে রোনালদো সেদিন জ্বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা সেই আসল রোনালদো না। ইংল্যান্ডের এক গোলের লিডকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সেদিন ব্রাজিলকে সেমিফাইনালের টিকেট এনে দেন ‘ছোট রোনালদো’ – পর্তুগিজ ভাষায় এ নামের অর্থ দাঁড়ায় রোনালদিনহো।
ওই ম্যাচটা ছিল ফুটবল মাঠে অনন্য এই শিল্পির শোডাউন মাত্র। সেই ম্যাচে করিয়েছেন গোল, গোল করেছেন নিজে – এরপর বিতর্কিত লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়েছেন ওই ম্যাচেই। লাল কার্ড দেখার আগে ৯০ মিনিটের ম্যাচে খেলেছেন মাত্র ৫৬ মিনিট, কিন্তু এই সময়েই তিনি দেখিয়েছেন তার সাম্বার চূড়ান্ত প্রদর্শনী। আপনার আক্ষেপ হতেই পারে, আরো ৩৫ খেললে হয়তো আরো জাদু দেখা যেত। তবে ওই সময়েই যে যাদু দেখিয়েছেন সেটাইকি যথেষ্ট না তাকে অনন্তকাল স্মরণ করার জন্য?
আপনি চাইলে ওই ম্যাচের গল্পের সাথে রোনালদিনহোর পুরো ক্যারিয়ারের গল্পই মিলিয়ে ফেলতে পারেন। কারণটা হয়ত বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ওই ম্যাচের মতই রোনালদিনহোর ক্যারিয়ারের বসন্ত ছিল ক্ষণিকের। তাতে কি? যেটুকু দেখিয়েছেন, যতবার মুগ্ধ করেছেন, যতভাবে বল নিয়ে কারিকুরি করেছেন – তাতে পৃথিবী নামক গ্রহের অসংখ্য মানুষ বুদ হয়ে দেখেছে তার খেলা, ভক্ত হয়েছে তার খেলার এবং একই সাথে ফুটবলকে ভালবেসে ফেলেছে চিরদিনের জন্য।
ফুটবলটা রোনালদিনহোর মতো করেই খেলতে হয়, যেখানে জয় কিংবা গোল মুখ্য না। একজন সত্যিকার শিল্পীর কাছে তাঁর আবেগ, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্যই সবার আগে। তোমারা মাঠে এসেছ ফুটবল উপভোগ করতে, আমি এসেছি তোমাদের সেই ফুটবল তৃষ্ণা পূরণ করতে। ফুটবল নান্দনিকতার চরম উৎকর্ষতা ছড়িয়ে রোনালদিনহো বল পায়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন শৈল্পিক ফুটবলের জয়গান। কি ছিল তাঁর এই শিল্পগুণের উৎস?
‘সৃষ্টিকর্তা সবাইকেই কোন বিশেষ গুণ দিয়ে তৈরি করেন। এদের কেউ ভাল লেখক হন, কেউ ভাল গায়ক হন। তিনি আমাকে ফুটবল খেলার দক্ষতা দিয়ে তৈরি করেছেন এবং আমি এর সর্বোচ্চটা ব্যবহার করছি।’ – ২০০৫ সালের ২৮ নভেম্বর ব্যালন ডি অর হাতে কথাগুলো বলেছিলেন রোনালদিনহো।
এটা বলার সপ্তাহ-খানেক আগেই অবশ্য স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তার শিল্পগুণের। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে সেবার বার্নাব্যুতে গিয়েছিলেন কাতালান রাজ্যের সেনাপতির পদ নিয়ে। রাজকীয় মাদ্রিদের মুকুটকে শুধু ভূপাতিত করেননি, সেদিন তার পায়ের মূর্ছনায় লস ব্লাঙ্কোস ফ্যানরা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে তার করা দ্বিতীয় গোলের পর দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় তারা। শুত্রুপক্ষের আঙিনা থেকে করতালি কুড়ানোর চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে একজন ফুটবলারের জন্য। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রোনালদিনহো এভাবেই তৈরি করেছেন অযুত ভক্তকূল যারা শুধুমাত্র তার জন্য ফুটবলের ফ্যান হয়েছেন।
বলছিলাম ২০০২ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের কথা। ওই ম্যাচে ২৩ মিনিটে ব্রাজিল পিছিয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত রক্ষণ যখন একের পর এক আক্রমণ থামিয়ে দিচ্ছিল তখন ব্রাজিলের জন্য বিশেষ কিছুই দরকার ছিল। বিশেষ কিছু মানে জাদুকরী কিছু। ঠিক মাঠের মাঝখানে বলটা পান রোনালদিনহো এবং এক পলকে বুঝতে পারেন এটাই সেরা সুযোগ।
সামনে সামান্য ফাঁকা পেয়ে বল নিয়ে দৌড় শুরু করেন। আর যে থামায় তাকে! সামনে আসতে থাকা কোলকে মোহনিয়া স্টেপ-ওভারে বোকা বানান। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা কিছু বুঝে উঠার আগেই বলটি ডান দিকে আগাতে থাকা রিভালদোকে বাড়িয়ে দেন। বিশ্বকাপ জয়ের আরেক নায়ক রিভালদোর অসাধারণ ফিনিশে লিড হারায় ইংল্যান্ড। গোলটাকে আপনি বার্সার হাতবদলের সাথেও তুলনা করতে পারেন। কারণ রোনালদিনহোর আগে রিভালদোই ছিল বার্সার সেনাপতি। তো সেই গোলে হয়ে গেল হাত বদল। প্রথমার্ধ শেষ হলো ১-১ গোলে।
এবার পালা আলোটা নিজের করে নেয়ার। রোনালদিনহোর লাল কার্ড দেখার ছয় মিনিট আগে ফ্রি-কিক পায় ব্রাজিল। প্রায় ৩৫ মিটার দূর থেকে পাওয়া ফ্রি-কিকটা নিতে আসেন রোনালদিনহো, পাশে ছিলেন কাফু। গোলপোস্টের সামনে দু’দলের খেলোয়াড়ের জটলা, রোনালদিনহোর ক্রসের অপেক্ষা সবার। গোলকিপার সীম্যানও সেই অপেক্ষাতেই ছিলেন, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি একটু সামনেই চলে আসেন। ডান পায়ের কিকে বলকে বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন রোনালদিনহো।
সবাই তাকিয়ে থাকলো অবাক দৃষ্টিতে। উচ্চতাটা এমন, কারো সাধ্য নাই সেটাকে ধরার। সবার দৃষ্টি ওই বলের দিকে। কি যে এক জাদুর জালে বন্দী হয়ে গেল মাঠের বাকি কুশীলবরা। গোলকিপারও চেয়েছিলেন তাড়াতাড়ি পিছনে গিয়ে সেই বলকে ধরতে। কিন্তু সেই উচ্চতার কোন কিছুকে কি কখনো ধরা যায়? নিখুত মাপে ভাসানো বলটা একেবারে টপ কর্নার দিয়ে জালে ঢুকে গেল।
গোলাজো! গোলাজো!! গোলাজো!!! রোনালদিনহো ঢুকে গেলেন ইতিহাসে। সময় নিয়েছেন সামান্য, কিন্তু সামান্য সময়ে যা করেছেন তা ছিল অনন্য।
পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন রোনালদিনহো, কিন্তু ফুটবল থেকে কি তাকে আলাদা করা সম্ভব কখনো? অনৈতিক অনেক কিছু করেই তিনি এখন ফুটবল দুনিয়ার অনেক অনেক দূরে। ভবিষ্যতে হয়ত আরো অনেক ফুটবলার আসবে যারা পরিসংখ্যানে অনেক এগিয়ে থাকবেন তাঁর চেয়ে। হয়ত জিতবেন অনেক বেশি সংখ্যক শিরোপা। কিন্তু বার্সাকে নতুন করে চেনানো এই জাদুকরের স্থান দখল করার মতো কেউ কখনো আসবেনা। রোনালদিনহো ফুটবল খেলেছেন ভালবাসা দিয়ে, আর সেই ভালবাসার প্রতিদান তিনি এখনো পেয়ে যাচ্ছেন তার ভক্তের কাছ থেকে। এই প্রজন্মের ফুটবল ভক্তরা তার গল্প পৌছে দিবে পরের প্রজন্মে, এরপর আরেক প্রজন্ম। এভাবে অনন্তকাল বেচে থাকবে তাঁর রুপকথার গল্প।
রোনালদিনহোকে হয়ত সর্বকালের সেরা ফুটবলার বলা যাবে না, কিন্তু নি:সন্দেহে বল পায়ে তিনি সর্বকালের সেরা ‘এন্টারটেইনার’। সৌভাগ্য আমাদের, রোনালদিনহোর খেলা আমরা উপভোগ করেছি।