একটা ছোট মুহূর্ত কত বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ষোড়শ ওভার শেষে হাঁটুর চোটে মাঠেই শুশ্রূষা হল ঋষাভ পান্তের। খেলা থমকে থাকল একটু। যে মোমেন্টাম তখন দক্ষিণ আফ্রিকা আর হাইনরিখ ক্লসেনের সঙ্গী, সেটাও থমকে গেল।
চাপ ব্যাপারটি বড্ড ভারী। উপলক্ষের চাপ। পরিস্থিতির চাপ। তাকে একটু পাত্তা দিলেই পেয়ে বসে। প্রবলভাবে, ওই যে একটু সময় খেলা বন্ধ থাকল, মোটেন্টামে ছেদ পড়ল, ক্লসেনের মনোযোগও নড়ে গেল। একটা প্রবাহে ভাসছিলেন তিনি, একটা ছন্দে ছুটছিলেন। ওই ছোট্ট বিরতিতে হয়তো তার মাথায় নানা কিছু খেলে গেল। মনোযোগ নড়ে গেল। সুরের সুতো কেটে গেল।
বিরতির পর প্রথম বল। স্টাম্পের অনেকটা বাইরে। স্লোয়ার ডেলিভারি। ক্লসেন ব্যাট চালিয়ে দিলেন। কিন্তু পা যেন কেউ আঠা দিয়ে আটকে রাখল ক্রিজে। ব্যস, ব্যাটের কানায় লেগে কিপারের হাতে বল। মোমেন্টামের বিরতিতেই সর্বনাশ, ক্রিকেট খেলাটা যতটা ব্যাট-বলের, ততটাই মস্তিষ্কের।
হ্যাঁ, তার পরও ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে ছিল। তবে ভারতেরও তো ছিল একজন জাসপ্রিত বুমরাহ! তাকে ‘ফ্রিক’ বললেও যেন ঠিক বোঝানো যায় না। বোলিংয়ের মাস্টারক্লাস বললেও কিছুই বলা হয় না। তাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
ম্যাচ শেষে ইয়ান বিশপ ঠিক এই প্রশ্নই করলেন রোহিত শার্মাকে। ভারতীয় অধিনায়ক বললেন, ‘আমি বুঝতে পারি, আপনারা তাকে ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। তবে আমি ওকে এত বছর ধরে দেখছি, একসঙ্গে খেলছি, এমনকি আমিও জানি না, ওর ব্যাপারটা আসলে কী! আমি জানি, সে কী করতে পারে। কিন্তু কীভাবে করে (তা জানি না)। এটা স্রেফ মাস্টারক্লাস।’
পরের ওভারটির কথাও বলতে হবে। আর্শদিপ সিং কী দারুণভাবেই চাপটা ধরে রাখলেন! ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট জাসপ্রিত বুমরাহ ও তা যৌক্তিকভাবেই। অন্য কেউ হতেই পারেন না। তবে স্রেফ একটু মনে করিয়ে দেই, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট আর্শদিপের (১৭টি, ফাজালহাক ফারুকির সঙ্গে যৌথভাবে)। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক আসরে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডও এটাই।
শেষ ওভারের প্রথম বলে সুরিয়াকুমার যাদবের অসাধারণ ক্যাচটি যদি না হতো, আমার ধারণা তবু ভারত জিতে যেত। তবে ক্যাচটিই আসলে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার আশার কফিনে। এরপর হার্দিক পান্ডিয়া শেষটা দারুণভাবেই করলেন।
শেষ বলটি করার পর তার দিকে লক্ষ্য করেছিলেন? বলটি করে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। সেভাবেই বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তার ঠোঁটের কোণে তখন অদ্ভুত এক হাসি, চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। ওই এক লহমায় হয়তো তার ভেসে গেল গত কয়েক মাসের টুকরো টুকরো ছবিগুলো।
চমকপ্রদভাবে তার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে ফেরা, বিতর্কিতভাবে নেতৃত্ব পাওয়া, রাতারাতি ভারতীয় ক্রিকেটে খলনায়ক হয়ে ওঠা, ‘ছাপড়ি’ থেকে শুরু করে নানা গালাগাল আর সমালোচনার শিকার হওয়া, ফর্মহীনতায় আরও সঙ্গীন অবস্থা, দাম্পত্য জীবন নিয়ে তোলপাড়, সব মিলিয়ে কী বিভীষিকার সময়!
সেই মানুষটিই আজ আসরের সবচেয়ে বড় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক। ম্যাচ শেষে তার যে কান্না – কে জানে, কত অভিমানের মেঘ তাতে গলে গেল, কত অপমনের জ্বালা মিটে গেল, কত আক্ষেপের পালা ঘুচে গেল।
যার টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়ে কয়েক বছর ধরেই নানা সময়ে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে, সেই ভিরাট কোহলি এই সংস্করণ থেকে বিদায় নিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচ-সেরা হয়ে। এটাকে নিয়তি বলবেন? নিয়তির এমন উপহার পেতেও তো একজন কোহলি হয়ে উঠতে হয়!
ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। তার মুকুটে টি-টোয়েন্টির পালকও যোগ হল। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি বাকি আছে। সময়ও তার হাতে আছে এখনও। শেষ ওভারে কাগিসো রাবাদা যখন আউট হলেন, ভারতের জয়টাও নিশ্চিত হয়ে গেল, অনেকেই তো উদযাপনে মেতে উঠলেন তখন। একজনের উদযাপন আপনার আলাদা করে নজর কাড়তে বাধ্য। মাঠের বাইরে রাহুল দ্রাবিড় উঠে দাঁড়ালেন উত্তেজনায়, মুষ্টিবদ্ধ হাত বাতাসে ছুড়ে হুঙ্কার দিলেন।
স্থিতধী দ্রাবিড়, শান্ত জল প্রবাহের মতোই স্থির দ্রাবিড়, বরাবরই আবেগকে চেপে রাখা দ্রাবিড়ের অমন উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠাই কি বলে দিচ্ছে না, এই জয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটা তীব্র ছিল! ভারতের কোচের দায়িত্বে তার শেষ ম্যাচ এটি। ‘ডু ইট ফর দ্রাবিড়’ প্রচারণা চলছিল স্টার স্পোর্টসে।
তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল ভারতে সামাজিক মাধ্যমে। ম্যাচের আগে সেটা থামানোর অনুরোধ জানিয়ে দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘আমি যে ধরনের মানুষ, এসব কোনোভাবেই আমার সঙ্গে যায় না। আমার মূল্যবোধের পুরো বিরুদ্ধে এসব। ‘কারও জন্য এটা করতে হবে’ এমন ধারণায় মোটেও বিশ্বাসী নই আমি। ওই কথাটি খুব ভালো লাগে আমার, কোনো একজনকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এভারেস্টে উঠতে চাও কেন?’ সে উত্তর দিয়েছিল, ‘এভারেস্টে উঠতে চাই, কারণ সেটা ওখানে আছে!’ আমার ক্ষেত্রেও এমন। কেন আমরা বিশ্বকাপ জিততে চাই? কারণ এটা এখানে আছে।’
‘এটা কারও জন্যই নয়, কোনো একজনের জন্য জেতার ব্যাপার নয়। এখানে জিততে হবে, এটিই আসল। আমরা ভালো ক্রিকেট খেলতে চাই। ‘অমুকের জন্য জিততে হবে’ এসব আমার সঙ্গে যায় না, আমার বিশ্বাসের সঙ্গে যায় না। এটা নিয়ে তাই কথা বলতে ও আলোচনা করতে চাই না। এই প্রচারণা যদি আপনারা সরিয়ে নেন, আমার ভালো লাগবে।’
এভাবে যিনি বলেন, তার জন্য কি আরও বেশি করে জিততে ইচ্ছে করে না? অধিনায়ক দ্রাবিড়ের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিব্রতকর পরাজয় যে ক্যারিবিয়ানে, ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হার, সেই ক্যারিবিয়াই কোচ দ্রাবিড়কে রাঙাল সবচেয়ে বড় অর্জনে।
দক্ষিণ আফ্রিকা আজ জিতলে হয়তো ‘চোকার’ তকমা খসে যেত। কিন্তু এখন আরও পোক্ত হয়ে এঁটে গেল তাদের সঙ্গে। এইডেন মার্করামের এই দল অন্যরকম, সত্যিই তা মনে হচ্ছিল। কিন্তু আসল সময়টাতেই যে তারা তলিয়ে গেল চেনা চোরাবালিতেই!
ম্যাচের শেষ বলটির পর রোহিত শার্মাকে দেখা গেল, উবু হয়ে শুয়ে আছেন মাঠে। ঘাসের সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলছিলেন না! তার কথা চলছিল নিজের সঙ্গে। অপ্রাপ্তিগুলোর সঙ্গে হয়তো এবার প্রাপ্তির বোঝাপড়া করছিলেন।
ভারতের নিয়মিত অধিনায়ক হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। সৌরভ গাঙ্গুলি কালকেই বলেছেন, অনেক বুঝিয়ে অনেকটা জোর করেই রোহিতকে দায়িত্বটি দিয়েছিলেন তারা। সেই দায়িত্বে কেবল হৃদয়ভাঙার যন্ত্রণাই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন।
নেতৃত্বের প্রশংসা অনেক পেয়েছেন। ব্যাটিংয়েও গত দুই বছরে নিজেকে ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু ট্রফি না থাকলে যে অনেক কিছুই মিথ্যে হয়ে যায়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হারলেন। আহমেদাবাদে লাখো দর্শকের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে নিজেও বিষাদে ডুবলেন। অবশেষে এই জয়।
এমন একটি জয় তাই অনেক প্রাপ্তির স্বাক্ষী হয়ে রয়। রোহিতের জন্য, দ্রাবিড়ের জন্য, কোহলির জন্য। হয়তো আরও অনেকের জন্য। স্রেফ একটি ট্রফিই তো নয়, একটি ক্রিকেট জীবনের স্বার্থককতাও।
– ফেসবুক থেকে