সৌম্যকে নিয়ে ছেলেখেলা বনাম সৌম্যর ছেলেখেলা

১৫১ বলে ১৬৯ রান, বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর যা এশিয়ান ব্যাটার হিসেবে তাসমান পাড়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ এবং অ্যাওয়ে ব্যাটার হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

সব মিলিয়ে সৌম্য সরকারের ইনিংসটা ছিল অনন্য, অতুলনীয় ও অসাধারণ। দলের বাকি সদস্যদের ব্যর্থতায় ম্যাচের ফলাফলে তা গুরুত্ব বহন না করলেও এ ধরনের ইনিংসকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কোনো। যে কারণে পরাজিত দলের সদস্য হয়েও ম্যাচ অ্যাজুডিকেটরের সিদ্ধান্তে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন সৌম্য।

সৌম্যর ইনিংসটা নিয়ে বেশিকিছু বলার নেই। এ ধরনের ইনিংস কতটা ভালো ছিল, তা সংখ্যাগুলোতেই প্রতিফলিত হয়। ব্যক্তিগত ৫০ থেকে ৬০ রানে যাওয়ার সময়টাতে একটু নড়বড়ে থাকলেও বাকি পুরোটা সময়ই টাইমিং ও প্লেসমেন্টে দুর্দান্ত ছিলেন সৌম্য। ওই নড়বড়ে থাকার সময় দুটা ক্যাচ ও একটা রিভিউ সারভাইভ করেন তিনি।

এদিন ভাগ্যও খুব সহায় ছিল তাঁর। নয়তো ব্যক্তিগত ৯৩ রানের মাথায় পয়েন্টে তুলে দেওয়া সহজ একটা ক্যাচ গেল ম্যাচে বাউন্ডারি লাইনে এক হাতে বল তালুবন্দি করা উইল ইয়াং মিসজাজ করে তালু ফসকাবেনই বা কেন!

যদিও এসবের কারণে ইনিংসটাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ক্রিকেটে ‘জীবন’ পাওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। দিনশেষে সেটাকে আপনি কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন, তা-ই বিবেচ্য বিষয়। এক্ষেত্রে সৌম্য সরকার লেটার মার্ক পেয়েছেন।

দীর্ঘ সময় পর সৌম্যকে কোনো একটা ম্যাচে স্বরূপে দেখাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক। তবে তিনি যে ছন্দে ফিরেছেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে একটা ইনিংস দেখেই কাউকে ছন্দে ফেরার সনদপত্র দিয়ে বসাতে আমার বেশ আপত্তি। বড়জোর বলা যায়, সৌম্য একটা ভালো ‘ব্রেকথ্রু’ পেয়েছেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে ধারাবাহিক হতে পারলে তবেই বলা যাবে, তিনি ছন্দে ফিরেছেন।

সংগত কারণেই সবশেষ বছর দুয়েকের মতো চলতি নিউজিল্যান্ড সফরেও দলে সৌম্যর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। কোনো ধরনের পারফরম্যান্স ছাড়াই স্রেফ অন্যদের ব্যর্থতায় তিনি বারবার দলে ফিরেছেন। সেজন্য নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন সৌম্য। তবে এসবের বিপরীতে তাঁর দুর্ভাগ্যের উদাহরণও রয়েছে।

২০২০ সালের কথা। করোনা বিরতির পর নিউ নরমালের সময়টাতে হুট করেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌম্যকে ওয়ানডেতে সাত নম্বরের জন্য প্রস্তুত হতে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হয়। তখন প্রস্তুতির জন্য পাঁচ মাসের মতো সময় পান সৌম্য।

এই সময়ে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ নামে একটা ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে বিসিবির আয়োজিত সেই টুর্নামেন্টের পুরোটাই উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে সৌম্যকে খেলানো হয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, তাঁকে সাত নম্বরে খেলানোর সেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার স্থায়িত্ব ছিল কেবল একটি সিরিজ।

২০২১ সালের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে মাত্র এক ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান তিনি। অথচ পরবর্তী সিরিজেই তাঁর ব্যাটিং পজিশনে পরিবর্তন আনে টিম ম্যানেজমেন্ট। নিউজিল্যান্ড সফরে এবার তাঁর ব্যাটিং পজিশন তিন নম্বরে। খেললেন তিনটি ম্যাচ, হলেন ব্যর্থ।

এমনকি ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এর পরের সিরিজে আবারো পরিবর্তিত ব্যাটিং পজিশনের জন্য দলে বিবেচিত হন সৌম্য। এবার তিনি নিজের নিয়মিত পজিশন ওপেনিংয়ের জন্য বিবেচিত হন ঠিকই কিন্তু বিকল্প ওপেনার হিসেবে।

যদিও সিরিজে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। শেষ ম্যাচে খেলানোর সুযোগ থাকলেও তাঁকে উপেক্ষা করে স্ট্যান্ডবাই থেকে নাঈম শেখকে সুযোগ দেওয়া হয়। তারপর তো দল থেকেই বাদ পড়ে যান তিনি।

এভাবে একদম নতুন একটা ব্যাটিং পজিশনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা বলে পরপর তিন সিরিজে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন পজিশনের জন্য তৈরি হওয়া এবং পারফর্ম করা মোটেও সহজ নয়। এখন কঠোর হয়ে বলতে পারেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের যে-কোনো পজিশনে খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

তাই বলে ওপেনিং থেকে সরাসরি সাতে খেলার জন্য নয়, টানা তিনটা সিরিজে তিনটা ভিন্ন পজিশনে তো নয়-ই। তাছাড়া তিনটা সিরিজে ব্যাট করতে পেরেছেন সাকুল্যে চারটা ম্যাচে। তাই সবমিলিয়ে ২০২১ সালে ওয়ানডে দল থেকে যেভাবে বাদ পড়েন সৌম্য, তাতে নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন তিনি।

তাই বলে যে প্রক্রিয়ায় তিনি এ বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম ও অ্যাওয়ে উভয় সিরিজেই দলে ফিরেছেন, সেটাকে ডিফেন্ড করা যাবে না। এমনকি তিনি ১৬৯ রানের দারুণ একটা ইনিংস খেলার পরেও না। দুই বছর আগে তাঁর ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়া এবং এখন দলে ফেরা, দুইটা প্রক্রিয়াই যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ।

আসলে এই যে পারফরম্যান্স ছাড়াই কোনো ক্রিকেটারকে দলে ফেরানোর প্রক্রিয়া, সেটা কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কাজে লাগে না, যা বিগত বছরগুলোতে সৌম্য সরকারের ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়েছে। দুয়েকটা হয়তো লেগে যেতে পারে, তবে সেটা শুধুই ‘ফ্লুক’।

যা-ই হোক! সৌম্য সরকার যে ফুরিয়ে যাননি, তাঁর মধ্যে যে এখনও সামর্থ্য রয়েছে, তার একটা ঝলক আজ নেলসনে দেখা গেল। নিশ্চয় এই ইনিংসটা তাঁকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। এই আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে এবার যত তাড়াতাড়ি তিনি ধারাবাহিক হবেন, ততই মঙ্গল।

সেটা তাঁর নিজের জন্য তো বটেই, দলের জন্যও। কেননা আমাদের দলে যথেষ্ট ভালো ক্রিকেটার থাকলেও ম্যাচ উইনারের সংখ্যা খুবই কম। সৌম্য হলেন সেই ‘ম্যাচ উইনার’-টাইপ ক্রিকেটার। ২০১৫ সালের সৌম্যকে দেখে থাকলে তাতে নিশ্চয় দ্বিমত করার সুযোগ নেই কারও!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link