২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। নিয়ম করে যে বিশ্বকাপ জুন-জুলাই মাসে আয়োজন করা হয়ে থাকে সেটি এখন নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচের দেশটিতে প্রথমবারের মতো ‘গেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে পরিচিত আসর নিয়ে কর্মের মহাযজ্ঞ চলছে।
সুন্দর আর নিরবিচ্ছিন্ন আয়োজনের পাশাপাশি নজর দেওয়া হচ্ছে অনেক দিকেই। যার মধ্যে নতুন করে স্টেডিয়াম নির্মান করা বিষয়টি রয়েছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের জায়গায়। শুনতে আশ্চর্য হলেও বলতে হচ্ছে, একটি স্টেডিয়ামই নির্মান করা হচ্ছে ভেঙে ফেলার জন্য! বিশ্বকাপের ম্যাচ আয়োজনের পর গুড়িয়ে দেওয়া হবে অনেক যত্নে গড়া এই মাঠটি।
সে কারণেই অংশগ্রহণকারীদের পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফাকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে, টুর্নামেন্টের অবকাঠামোগত নির্মাণের সময়েও টেকসই নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আয়োজক দেশ কাতার। দেশটির আয়োজক কর্তৃপক্ষ আরও দাবি করেছে, বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ভবন নির্মাণে তারা এমন উপকরণ ব্যবহার করেছে যা সর্বোচ্চ উপযোগিতা দিবে এবং কার্বন নি:সরণ, আবর্জনার পরিমাণ ও জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব কিছুটা হলেও কমাবে। দোহা বন্দরের উপকন্ঠে আলাদা উচ্চতার ৯৭৪টি শিপিং কন্টেইনার দিয়ে গঠিত রাস আবু আবুদ স্টেডিয়ামে এবার ২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত সাতটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এটা বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র অস্থায়ী ভেন্যু।
স্টেডিয়ামটিকে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ ম্যাচ আয়োজনের জন্য অস্থায়ীবাবে নির্মান করা হচ্ছে। একসময় পারস্য সাগরের তীরের অঞ্চলটিতে জীবনের তেমন কোন চিহ্ন ছিল না; আর সেখানে এখন নানা রঙ এর বাহার এবং জনমানুষে রীতিমতো পরিপূর্ণ। আর কিছুদিন পরেই সেখানে শোনা যাবে ৪০ হাজার দর্শক-সমর্থকদের চিৎকার। কাতারের রাস আবু আবুদ স্টেডিয়ামটি ইতিহাসের প্রথম ফুটবল স্টেডিয়াম যা আসলে ভেঙে ফেলার জন্যই তৈরি করা হচ্ছে।
সবগুলো শিপিং কন্টেইনারই পরিশোধিত স্টীল থেকে তৈরি এবং গায়ে ৯৭৪ সংখ্যাটি লেখা, যা কাতারের ডায়ালিং কোড এর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি একই সাথে দেশটির টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিশ্রুতি ও নিজস্ব পরিচয়কে প্রতিনিয়তই তুলে ধরছে। টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই স্টেডিয়ামের বিভিন্ন অংশ, রিমুভেবল সিট, কন্টেইনার এবং ছাদ পর্যন্ত পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে।
পাশাপাশি পরে কাতার কিংবা কাতারের বাইরের অন্য কোনো খেলার অনুষ্ঠানে বা সাধারণ অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হবে। রাস আবু স্টেডিয়াম র্নিমানের সাথে জড়িত একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ আল আতওয়ান সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘এমন ষ্টেডিয়ামের কথা সাধারনত ফুটবলপ্রেমীরা জানেন না, এমনকি পরিচিতও নয়। ৪০ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার এই ভেন্যুর প্রতিটি জিনিসই ভেঙে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব এবং সেগুলো দিয়ে ২০ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি স্টেডিয়াম বানানোর মতো সক্ষমতা রয়েছে। আর এটাই এই স্টেডিয়ামের আসল সৌন্দর্য্য।’
এছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি, কাতার এটাও প্রত্যাশা করছে যে এই স্টেডিয়ামটি ভবিষ্যত ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের অগ্রদূত হবে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এদিকে এই ষ্টেডিয়ামটি কি অন্যান্য ষ্টেডিয়ামের মতো টেকসই হবে কিনা সেই সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
গত জুনে প্রকাশিত ফিফার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২২ বিশ্বকাপ সব মিলিয়ে ৩৬ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নি:সরণ করবে; যা ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত রাশিয়া বিশ্বকাপের চাইতে ১৫ লাখ টনেরও বেশি! তাই কার্বন নিরপেক্ষ বিশ্বকাপ আয়োজন করতে উপসাগরীয় দেশ কাতারের এই প্রচেষ্টা যে সর্বমহলে সাড়া ফেলবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এদিকে টুর্নামেন্টের অবকাঠামোগত নির্মাণের সময়েও টেকসই নির্মাণের প্রতিশ্রুতি শুরু থেকেই দিয়ে আসছে কাতার। দেশটির আয়োজক কর্তৃপক্ষ আরও দাবি করেছে, ভবন নির্মাণে তারা এমন উপকরণ ব্যবহার করেছে যা সর্বোচ্চ উপযোগিতা দিবে এবং কার্বন নি:সরণ, আবর্জনার পরিমাণ ও জীববৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব অনেকাংশেই কমাতে সহায়তা করবে। যা টেকসই ধারণক্ষমতা এবারের আয়োজনের অন্যতম লক্ষ্য বলেও আয়োজকদের পক্ষ থেকে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে। আর সে কারণেই গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে সারা বিশ্বে বিশ্বকাপের সকল অবকাঠামোকে ঘিরে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগানো হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপ দেখতে আগত দর্শকদের পাশাপাশি সংবাদকর্মীদেরকেও তারা সুপারিশ করবে কিভাবে তারা ভ্রমণ, বাসস্থান ও খাদ্যের মত খাতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে পারে। কাতার আরও জানিয়েছে, বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘোষণার পরপরই তারা দুটি বৃহৎ সৌর প্রজেক্ট বানাবে, যেগুলো টুর্নামেন্ট চলাকালীন কার্বন নির্গমনকে পুষিয়ে দেয়ার জন্য পরবর্তী ১০-১৫ বছর পর্যন্ত কাজ করতে থাকবে, যা দেশের জন্য অনেকক্ষেত্রে মঙ্গল বয়ে আনবে। সে হিসেবে তারা একটা বড় যুদ্ধ জয় করতে যাচ্ছেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
কাতার-২০২২ এর বাকি সব ভেন্যুর মতো রাস আবু আবুদ স্টেডিয়ামের এ অস্থায়ী বন্দোবস্ত এই প্রমাণ করে যে, দেশটি কম সময়ে কম খরচে অবকাঠামো নির্মাণের দিকেও সমপরিমান নজর দিচ্ছে। আয়োজকদের তথ্যমতে আরও জানা গেছে, ৪৮ লাখ বর্গফুটের এই স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ বছরের শেষ দিকে এটি পুরোপুরি ব্যবহার উপযোগী হবে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানা গেছে।
এর পাশাপাশি সমুদ্রের হিমশীতল হাওয়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। রাস আবু আবুদ স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে বাইরে পা রাখলেই দোহার পশ্চিম উপসাগরীয় দিগন্তের সাথে দেখা মিলবে ফুটবল ভক্তদের। আর যখন সমুদ্রতীরে সূর্য ডুবে যাবে, তখন একপাশে আকাশচুম্বী ভবন ও অন্যপাশে স্টেডিয়ামের মধ্যে বর্ণিল আলোর বিনিময় সমুদ্রতীরে প্রতিফলিত হয় এবং শহরকেও নিয়মিতভাবেই আলোকিত করে তোলে। বিশ্বকাপের জন্য কাতারের নির্ধারিত সকল স্টেডিয়ামেই অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে, যা একটি শীতল আর আরামদায়ক আবহাওয়া তৈরি করে থাকে।
কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বকাপের জন্য রাস আবু আবুদ ষ্টেডিয়ামে সেই কৃত্রিম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোন প্রয়োজন হয় না, কারণ পার্শ্ববর্তী সমুদ্র থেকেই সেখানে শীতল বাতাস আসতে থাকে। প্রজেক্ট ম্যানেজার আল আতওয়ান মনে করেন, এই স্টেডিয়ামের মূল অবস্থানটি খুবই সুবিধাজনক এবং এখানে একাধিক প্রজেক্টের কাজ করা যাবে বিধায় এর দারুণ ভবিষ্যত আছে বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। অনেক চমকের ভীড়ে এই ষ্টেডিয়াম দিয়ে আরও একটি চমক দেখাতে যাচ্ছে কাতার।