দৃশ্যটা কল্পনা করুন। আপনার ষোল বছরের ছেলে ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছে। বিপক্ষ দলের বোলারদের নাম ইমরান, আকরাম ও ওয়াকার। খেলাটা পাকিস্তানের মাটিতে, পিচ এতটাই সবুজ যে কোথায় পিচ শেষ হয়েছে সেটা পর্যন্ত ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না।
এবার তারপরের দৃশ্য। আপনার ছেলে ওয়াকারের বাউন্সারে আঘাত পেল। ওর নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
এই অবস্থায় আপনি ঠিক কী করবেন? প্রার্থনা? কিসের প্রার্থনা? ছেলে সেঞ্চুরি করুক নাকি তাড়াতাড়ি আউট হয়ে সুস্থ শরীরে প্যাভিলিয়নে ফেরত আসুক? সে না হয় ষোল বছরের কিশোরের জেদ ধরে বলছে ‘ম্যায় খেলেগা’ কিন্তু আপনি তো আর টিন এজার নন। আপনার কি মনে হবে না আপনার ছেলের জীবন নিছক একটা খেলার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
সত্যি কথা বলতে কি নিজে বাবা হওয়ার আগে অবধি শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের ষোল বছর বয়সে পাকিস্তানের ওই বোলিং খেলার দু:সাহসিকতার কথা আমি ঠিকমত বুঝতে পারি নি। আজ পারি কারণ আমার ছেলের বয়স যখন ষোল ছিল তখন সে একা পার্ক সার্কাসে ক্লাস করতে গেলে একই সঙ্গে গর্বিত ও উদ্বিগ্ন হতাম।
ছোটখাটো চেহারার ভিশি যখন উনিশ বছর বয়সে রঞ্জি খেলেন তখন নাকি বিপক্ষের ফাস্ট বোলাররা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে ছেলেটাকে অন্তত দশ রান করতে দেওয়ার পর আউট করার চেষ্টা করবে (অবশ্য তার ফল ভালো হয়নি। বিশ্বনাথ শেষ অব্দি ২৩০ রান করে থামেন।)। ইমরান পরিচালিত পাকিস্তান বাহিনী অবশ্য সেই পথে হাঁটেনি। বরং শচীন ক্রিজে নামলেই বাউন্সার বর্ষণ আরম্ভ হত।
শচীন অবশ্য অভিমন্যু নয়, অর্জুন হওয়ার লক্ষ্যে নেমেছিলেন। ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তিনি প্রমান করেন যে ওনার মাপের ব্যাটসম্যান শুধু ভারতেই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই খুব বেশি জন্মায় নি। সব ধরনের বোলিঙের বিরুদ্ধে, সব ধরনের পিচে নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে যখন তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানান তখন টেস্ট এবং একদিনের ম্যাচের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডই ওনার পকেটে। এই রেকর্ড আরও ভালো হত উনি কিছুদিন আগে খেলা ছাড়লে। বা কিছুদিন পর খেলা আরম্ভ করলে।
ক্রিকেট ইতিহাসে শচীনের স্থান কোন জায়গায়? আমার কাছে তিনি ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। শুধু টেস্ট ধরলে হয়ত সানি বা রাহুল আলোচনায় আসতে পারতেন কিন্তু সঙ্গে একদিনের ম্যাচ ধরলে আলোচনারও অবকাশ নেই। বিশ্ব ক্রিকেটেও যাদের খেলা দেখেছি, লাইভ বা রেকর্ডিং, তাদের মধ্যে তার সঙ্গে তুলনায় আসার মতো মাত্র দুইজন ব্যাটসম্যান আছেন – ভিভ রিচার্ডস ও ব্রায়ান লারা।
প্রথম জন নি:সন্দেহে বেশি ধ্বংসাত্মক কিন্তু ওনার সঙ্গে বেশ কিছু কাছাকাছি মানের ব্যাটসম্যান ছিল যাদের ভরসায় তিনি নিশ্চিন্তে স্ট্রোক খেলতে পারতেন। তাছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির ভয়ে বিপক্ষ দলের ফাস্ট বোলাররা তাকে বাউন্সার-টাউন্সার একটু কম দিত বলেই মনে হয়।
একজন দর্শক হিসেবে শচীনের চেয়ে লারার ব্যাটিং আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় কিন্তু নিজের পিক পিরিয়ডে শচীনের ধারাবাহিকতা এবং নির্ভরযোগ্যতা অনেকটাই বেশি। আর একদিনের ম্যাচে শচীনের প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। এখানে একমাত্র ভিভ এবং আধুনিক যুগে বিরাট তার সঙ্গে কম্পিট করার মত অবস্থায় থাকবেন।
একটা অভিযোগ আজকাল প্রায়ই দেখতে পাই – সেঞ্চুরির আগে শচীন নাকি স্লো খেলতেন। অভিযোগটা অবশ্যই একদিনের ম্যাচ কেন্দ্র করে। এর থেকে নাকি প্রমাণিত হয় যে সচিন স্বার্থপর ক্রিকেটার ছিলেন।
এই অভিযোগ হাস্যকর। স্বার্থ আমাদের সবার জিনেই রয়েছে। আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বার্থপর না হলে আজকে আমাদের এই পৃথিবীতে অস্তিত্বই থাকত না। ডারউইনের থিয়োরি অফ এভ্লিউশনকে এক কথায় ‘সারভাইভাল অফ ফিটেস্ট’ না বলে অনায়াসে ‘সারভাইভাল অফ সেলফিশেস্ট’ বলা যেতে পারে।
তবে এই স্বার্থপরতার প্রকাশ এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকমের। কেউ রেকর্ড করে সন্তুষ্ট হন, কেউ বল গ্যালারিতে ফেলে। দ্বিতীয় কাজ করতে গিয়ে এক বিখ্যাত ওপেনার কোচের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন, আরও এক বিখ্যাত অলরাউন্ডার দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। অথচ সেঞ্চুরির জন্য ধীরে খেলতে গিয়ে কেউ বাদ পড়েছেন বলে আমার জানা নেই (বড়জোর ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়া হয়েছে বা অবসর নেওয়ার পর কয়েকটা পোস্ট লেখা হয়েছে ফেসবুকে)। তাহলে একটা যুক্তিবাদী ব্যাটসম্যান কোনটা করবেন?
অফিসেও কাজকর্ম করতে গিয়ে কোম্পানি বা দেশের কথা চিন্তা করে কেউই অহেতুক ঝুঁকি নেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের এবং যে সংস্থায় আমরা কাজ করি – এই দুটোর স্বার্থ মিলে গেলেও যেখানে মেলে না সেখানে কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কয়েকজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন ক্ষুদিরাম, ভগত সিং, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, যীশু বা মাদার টেরেসা নিজের নিঃস্বার্থ জিন পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে পারেন নি। তাই নিঃস্বার্থ ব্যাক্তি সব সময়ই ব্যাতিক্রম। আমাদের শাস্ত্র পর্যন্ত নিজে মোক্ষ লাভ করার পরই জগত-হিতে রত হওয়ার পরামর্শ দেয়।
এত কিছুর পরেও বলে রাখা ভালো যে আমি শচীনের ফ্যান নই। প্রথম কারণ, তিনি যখন ক্যারিয়ার আরম্ভ করেন, তার কয়েক বছর আগেই ভারতীয় ক্রিকেটের ‘হি ম্যান’ আমাদের প্রজন্মের আনুগত্য দখল করে ফেলেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, শচীনের প্রথম টেস্ট কপিলের শততম টেস্ট ছিল।
আরও একটা বড় কারণ, নিজের থেকে এক মাস ছোট একটা ছেলের ফ্যান হওয়া সহজ নয়। মনের মধ্যে কিছুটা ঈর্ষা, কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করে। সেই সঙ্গে কাজ করে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে এমন একটা আত্মবিশ্বাস যার কোন ভিত্তি নেই। তাই এই বয়সে নতুন হিরো গ্রহণ করা খুব শক্ত।
আমি নিশ্চিত শচীনের পিক পিরিয়ডে আমার বয়স ১২-১৩র রেঞ্জে থাকলে আমিও শচীনেরই ভক্ত হতাম। সে ক্ষেত্রে ভিভ-লারা তো বটেই, স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের থেকেও শচীনকে বড় ব্যাটসম্যান প্রমান করতে সচেষ্ট হতাম। এবং সেটা শচীনের রেকর্ড ঘেঁটেই। সেই চেষ্টাটা শচীনের ভক্তরা করেন না দেখে একটু আফসোসই হয়।