রাজপুরুষ বনাম বিষাক্ত পায়রা

প্রতিবার ম্যাকগ্রা বল হাতে যখন রান আপে হাঁটতেন, আর অন্যপ্রান্তে দাঁড়াতেন শচীন— বাইশ গজ থেমে যেত। থেমে যেন গ্যালারির নিশ্বাস। একজন আঁকছিলেন নির্মাণ, আরেকজন খুঁজছিলেন ধ্বংস। যেখানে শব্দের চেয়েও বেশি কথা বলত নীরবতা।

নিখাঁদ দ্বৈরথ। বারুদের বাতাসে সাবলীল সংযম আর নিখুঁত কারুকার্যের রূপকার — শচীন টেন্ডুলকার। অন্যদিকে গ্লেন ম্যাকগ্রা, বিষাক্ত পায়রা। নির্মমতা আর ক্লিনিক্যাল নির্ভুলতার কুশলী কাণ্ডারি।

জোহানেসবার্গের বাতাসে তখন আগুনের গন্ধ। সময় ২০০৩। বিশ্বকাপের অগ্নিপরীক্ষায় ভারতের প্রথম ব্যাটিং, আর অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই নিষ্ঠুর ধৈর্যের প্রতিমূর্তি—গ্লেন ম্যাকগ্রা। পরপর তিনটি বল যেন কাঁচের মতো ধারালো সুইংয়ে কেটে নেয় শূন্যতা। চতুর্থটা হঠাৎ যেন মায়ার হাতছানি—হালকা খাটো লেংথ।

শচীন টেন্ডুলকার, যেন এক চেনা গল্পের পুরোনো সৈনিক, অপেক্ষায় ছিলেন ঠিক এই বলটার জন্য। পিছন পায়ে ঘুরে অফ থেকে টেনে মিডউইকেট—যেন সময়কে থামিয়ে দেওয়া এক পুল। ব্যাটের শব্দটা যেন আশার ধ্বনি হয়ে ভেসে আসে মহাদেশ জুড়ে। চার রান নয়, যেন কোটি কোটি মানুষের বুকের কাঁপন!

তখনই বোঝা যায়—এই এক ব্যাট যদি চুপ হয়ে যায়, তাহলে হয়তো তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফিরে যাবে সেই ডনের দেশে। আর এই এক ব্যাট যদি জেগে ওঠে, তাহলে পিজিয়নের যত কৌশল, সব হবে অর্থহীন। এই এক লড়াই—যেখানে দুই অস্ত্র, দুই ব্রহ্মাস্ত্র—একদিকে এমআরএফ, আরেকদিকে কোকাবুরা!

সেই একই ফাঁদ। বাউন্সার, অফস্টাম্পের বাইরের লাইন, আর খাটো লেংথে সাজানো জাল। শচীন জানতেন কী আসবে। ম্যাকগ্রাও জানতেন শচীনের মন। ব্যস, সব ভেঙেচুড়ে গেল। যদিও, গল্পটা শুরু আরও আগে থেকে।

শারজাহ, ১৯৯৪। সেই প্রথম। ২০ বছর বয়সী শচীন, চোখে আগুন। ম্যাকগ্রা তখনো নাম করে উঠছেন। দুটি বাউন্সার, একটি মিসটাইম পুল—চতুর্থ বলে শর্ট লেগে ধরা পড়লেন। লড়াই শুরু হয়ে গেল। বোঝা গেল এটা চটজলদি মীমাংসার যুদ্ধ নয়, এটা মহাকাব্য হবে।

কাট টু ১৯৯৬ বিশ্বকাপ। ম্যাকগ্রা জানতেন শচীনের উচ্চতা তুলনামূলক কম, তাই বাউন্সার নয়—এইবার ফাঁদ নিচু বলের। ব্যাক অফ লেংথ, গুড লেংথ—এই দোলাচলেই বাঁধলেন শচীনকে। পজিশন পাল্টে সামনে এগিয়ে এলেন শচীন, মিডউইকেটের ওপরে ছক্কা হাঁকালেন। বোলারের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিলেন এক স্ট্রোকেই।

১৯৯৯ সাল। ম্যাকগ্রার প্রাইম সময়। এই সময় ১৯-এর আশেপাশে তাঁর বোলিং গড়। অফস্টাম্পের বাইরে বল রেখে শচীনকে বারবার ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেললেন। মেলবোর্নে পাল্টা পরীক্ষায় নামলেন শচীন। চার ওভার অপেক্ষা, তারপর স্টাম্প টু স্টাম্প লাইনে ছক্কা, চার—পিজিয়নের বিষ এবার নীলকণ্ঠ গিলে ফেলল।

২০০১ সালের মুম্বাই। শচীন এবার বদলে ফেললেন স্টান্স। মিডলস্টাম্প কভার করে ম্যাকগ্রার ইনসুইংয়ের মুখোমুখি। বড় এক চাল। ম্যাকগ্রা জয়ী। পরের ইনিংসেই শচীন ফিরলেন চেনা স্টান্সে, চেনা ছন্দে। চেন্নাইয়ে তুলে নিলেন ১২৬ রান।

পরের দেখা  নাইরোবিতে, আইসিসির নকআউট আসরে। সেই ১৯৯৪-র শারজাহর ছোট্ট ছেলেটা ভব্যতার আবরণে মোড়া প্রতিশোধের ভঙ্গিতে যেন বললেন, ‘এই লড়াই এখনও শেষ হয়নি।’ সংখ্যা বলবে— টেস্টে ৭ বার আউট, ওয়ানডেতে ৬ বার ম্যাকগ্রার ফাঁদে পড়েছেন শচীন। ব্যাটিং গড় ৪৮-এর ওপরে। যুদ্ধের ফলাফল তাই কখনো ফায়সালা দেয়নি।

কিন্তু, প্রতিবার ম্যাকগ্রা বল হাতে যখন রান আপে হাঁটতেন, আর অন্যপ্রান্তে দাঁড়াতেন শচীন— বাইশ গজ থেমে যেত। থেমে যেন গ্যালারির নিশ্বাস। একজন আঁকছিলেন নির্মাণ, আরেকজন খুঁজছিলেন ধ্বংস। যেখানে শব্দের চেয়েও বেশি কথা বলত নীরবতা।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link