প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি – জাসপ্রিত বুমরাহর ক্ষেত্রে আমি যতটা ভুল ছিলাম, নিজের ক্রিকেট দেখার জীবনে অন্য কোনো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে ছিলাম না। ঐ অ্যাকশন নিয়ে যে ও কোনোদিন টেস্ট খেলতে পারবে সেটাই চিন্তা করিনি। আমি নিশ্চিত যে দিনের পর দিন বিভিন্ন কোচ এবং বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে নিজেকে বদলে ফেলার পরামর্শ পেয়ে এসেছেন বুমরাহ। আমরা ভাগ্যবান যে তিনি তাদের নয়, নিজেকে বিশ্বাস করেছেন।
বুমরার বোলিঙে বল রিলিজ করার আগের সবকিছুই ভুলে ভরা। ছন্দবদ্ধ দৌড় – নেই। ক্লাসিক সাইড অন অ্যাকশন – নেই। বল রিলিজের আগে বিধ্বংসী লাফ – নেই। কিন্তু যেটা আছে সেটা তাকে আজকের প্রজন্মের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারে পরিণত করেছে – অসাধারণ নিয়ন্ত্রন, উইকেটের দুই দিকেই বলকে বাঁক করানোর ক্ষমতা, প্রয়োজন মতো উইকেট থেকে বাউন্স আদায় করে নেওয়া।
এর সঙ্গে যোগ করুন দুরন্ত পেস এবং ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক। আজকের বুমরা কমপ্লিট প্যাকেজ! এটা সম্ভবত নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বল হাতে ক্রিজের অপর প্রান্তে বুমরাহকে দেখলে এমন কোনো ব্যাটসম্যান নেই যে নিজের মেরুদণ্ডের মধ্যে শীতলতার অনুভব করেন না।
বুমরাহ যে সত্যিই স্পেশাল সেটা প্রথম বুঝেছিলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওর পারফর্মেন্স দেখে। যে টি-টোয়েন্টিকে বোলারদের গোরস্থান বলা হয়, তার সবচেয়ে বড় যজ্ঞে বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানদের নিজের ছন্দে নাচতে বাধ্য করেছিলেন বুমরাহ।
তার চারটি ওভারে রান করা নয়, নিজের উইকেট বাঁচানোর দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। উইজেডেনে একটা রচনা রয়েছে যেখানে লেখক ডেটার সাহায্যে প্রমাণ করেছেন কীভাবে বুমরার স্পেলের প্রভাব তার বোলিং করতে আসার আগে ও পরেও ম্যাচগুলিতে বজায় ছিল।
তবু আমার মনে সন্দেহ ছিল এবারে অস্ট্রেলিয়ায় কতটা সফল হবেন বুমরাহ। সন্দেহের প্রধান কারণ, বুমরা ছোট ছোট স্পেলে বেশি কার্যকারী। অথচ এবার তাকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো পেস বোলার দেখতে পাচ্ছিলাম না, বিশেষ করে মোহাম্মদ সিরাজের সাম্প্রতিক ফর্ম এবং মোহাম্মদ শামির অনুপস্থিতি ভারতকে ভোগাবে বলে মনে হয়েছিল।
আরও অবাক হলাম প্রথম টেস্টে ভারতের টিম সিলেকশান দেখে – আশ্বিন বা জাদেজার মতো উইকেট টেকিং স্পিনারও দলে নেই। কুড়িটা উইকেট আসবে কোথা থেকে? অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে চার চারজন বিশ্বমানের বোলার।
ভারতের প্রথম ইনিংস স্ক্রিপ্ট মেনেই অল্প রানে শেষ হোল। এবার অস্ট্রেলিয়া একটা বড়সড় লিড নিলেই খেলা শেষ। তারপর আরম্ভ হোল বুমরা ম্যাজিক। একটা ছোট্ট স্পেলেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে মেরুদণ্ড দুমড়ে দিয়ে প্রবলভাবে ম্যাচে ফেরালেন ভারতকে। তারপর যেন তারই তেজে সংক্রামিত হয়ে সিরাজ এবং রানাও নিজেদের ছাপিয়ে গেলেন। অবিশ্বাস্য ভাবে প্রথম ইনিংসে লিড নিল ভারত।
তারপর যশস্বী, রাহুল এবং বিরাটের দাপটে অস্ট্রেলিয়াকে প্রায় অসম্ভব লক্ষ দিয়ে দান ছাড়ল ভারত। এবং এমন সময় ছাড়ল যে অস্ট্রেলিয়াকে আধ ঘণ্টা সামলাতে হবে বুমরাদের। হাসিমুখে কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বোলিং মার্কের বুমরাহ বোলিং মার্কের দিকে এগোচ্ছেন। ভাবখানা – আব আয়গা মজা!
তারপর আবার দেখতে পেলাম ফাস্ট বোলিংয়ের মাস্টারক্লাস – শুধু গতি, বাউন্স এবং স্যুইং-ই নয়, দেখতে পাওয়া গেল ব্যাটসম্যানকে কীভাবে সেট আপ করে তার উইকেট দখল করছেন বুমরাহ। সেই পড়ন্ত বেলাতেই ম্যাচ পুরোপুরি ভারতের দখলে চলে এল। শেষদিন কিছুটা লড়াই চালালেন হেড – ভারতের পুরাতন শত্রু। আবার ফিরলেন বুমরাহ।
একটু পরেই দেখা গেল দুর্দান্ত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। তারপর তার শেষ চিৎকার – পার্থে অস্ট্রেলিয়া নিধন সম্পূর্ণ হল! টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করতে গেলে নাকি ভারতকে এই সিরিজে অন্তত চারটি টেস্ট জিততে হবে। কয়েকদিন আগেও কেউ সেই কথা তুললে হাসি পেত।
কাজটা এখনও প্রায় অসম্ভব তবে এখন হয়ত হাসতে হাসতে বলব, দেখা যাক। কারণ শুধু বুমরাহ-তো নয়, রাজা এবং রাজপুত্রও জেগে উঠেছেন।