হারিস রউফ, শূন্য থেকে মিস্টার ১৫০

২০১৭ সালের গ্রীষ্ম মৌসুম, ইসলামাবাদ থেকে তিনজন ছেলে গুজরানওয়ালাতে ক্রিকেট ট্রায়াল দেয়ার জন্য গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে রওয়ানা দিয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাঁদের পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্টেডিয়ামের দরজা। কিন্তু এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখানে থেমে যেতে চায়নি তাঁরা, গেটের তালা ভেঙে মিশে যায় প্রতিযোগীদের ভিড়ে।

সেই তিনজন অদম্য বালকের মধ্যে একজনই কেবল চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পেরেছিল। তাঁর করা একটা বলের গতি ঘন্টায় ৯২ মাইল হয়েছিল, আর তা দেখে বিস্মিত হয়েছেন সেখানে উপস্থিত থাকা আকিব জাভেদ এবং কোচেরা। সেদিনের ৯২ মাইল বেগে বল ছোঁড়া সেই বোলারই আজকের হারিস রউফ, পাকিস্তানের মিস্টার ১৫০।

অন্য অনেকের মত গলিতে ক্রিকেট খেলেই বেড়ে উঠেছেন এই পেসার। কিন্তু বোলিং একশনের অজুহাতে তাঁকে প্রায় খেলতে বাধা দেয়া হতো, তবে রউফ মনে করে গতি বেশি হওয়ায় খেলতে পারতো না ব্যাটাররা এজন্যই তাঁকে নিতে চাইতো না অন্যরা।

নিজের ঘরেও সমর্থন পাননি হারিস রউফ, বাবার হাতে মারও খেয়েছেন খেলার কারণে। এমনকি তাঁর ক্রিকেট খেলার সরঞ্জামও বন্ধুর ঘরে রাখতে হতো। স্কুল ফাঁকি দিয়েও কত দিন ম্যাচ খেলতে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু ক্রিকেট কাঠামো সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিল না রউফের। তিনি বলেন, ‘আমি অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-১৮ সম্পর্কে কিছু জানতাম না। কিন্তু ডায়মন্ড গ্রাউন্ডের পাশের একটি বাসায় চলে যাওয়ার পরে প্রথমবার এসব নিয়ে জানার সুযোগ পাই। কাঠের বলের খেলা কিভাবে হয় সেটা দেখার জন্য আমি ওই মাঠে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের সময় থাকতাম।’

ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আক্তারদের মতই টেপ টেনিস ক্রিকেট দিয়েই উঠে এসেছেন হারিস রউফ। সে ব্যাপারে তিনি জানান, ‘আমি টেপ টেনিসে খেলতাম অর্থের জন্য; স্কুল-কলেজের ফিস আমাকে ম্যানেজ করতে হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর আমাকে দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বেশি হওয়ায় টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে হতো অনেক।’

এরপরই একদিন কাঠের বলে ট্রায়াল দিতে গুজরানওয়ালাতে ছুটে যান এই ডানহাতি। সেখানে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেয়ার গল্প তো আগেই জানা।

আকিব বলেন, ‘যখন আপনি নব্বই মাইল গতির বোলার ‘র ট্যালেন্ট’ হিসেবে পাবেন, তখন আপনাকে সেটার যত্ন নিতেই হবে।’ তারপর লাহোর কালান্দার্সের একাডেমিতে সুযোগ হয়ে যায় রউফের, সেই সাথে শুরু হয় নতুন দিগন্ত।

পাকিস্তান সুপার লিগের তৃতীয় সংস্করণে নেট বোলার হিসেবে কাজ করার জন্য ডাক পান হারিস রউফ। পাকিস্তানের সাবেক এই ক্রিকেটার বলেন, ‘ব্রেন্ডন ম্যাককালাম অবাক হয়েছিল রউফকে দেখে। এবং প্রশ্ন করেছিলেন কেন তাঁকে স্কোয়াডে রাখা হয়নি। তবে আমাদের লক্ষ্য ছিল রউফকে পরবর্তী ১০/১২ বছরের জন্য তৈরি করা। তাই তাড়াহুড়ো করিনি।’

২০১৯ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, পিএসএলে অভিষেক হয় হারিস রউফের। অভিষেক ম্যাচেই ২৩ রানে চার উইকেট তুলে নিয়ে একাই ধ্বসিয়ে দেন করাচি কিংসের ব্যাটিং লাইনআপ। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কারও জিতেছেন তিনি।

সেদিন থেকে আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি এই এক্সপ্রেস পেসারকে। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কল্যাণে শুধুই এগিয়েছেন সামনের দিকে। অন্য পেসারদের মত একটা বল ১৫৫কিমি/ঘণ্টা, বাকিগুলো ১৩৫ – এভাবে বোলিং করেন না তিনি। বরং টানা ১৫০ এর আশেপাশে বল করে যান এই তারকা।

এগ্রেশনও বাকিদের চেয়ে আলাদা করেছে তাঁকে। আর এই আগ্রাসন ম্যাচে আরো মনোযোগী হতে সাহায্য করে বলেও জানান তিনি। আর এই ক্ষেত্রে তাঁর আইডল বিরাট কোহলি এবং ডেল স্টেইন।

আকিব জাভেদের মতে, হারিস রউফের গড় গতি আর এনার্জি লেভেল সবচেয়ে সেরা। পারফরম্যান্সের দিক দিয়েও সেরা হবেন – এমনটাই এবার লক্ষ্য এই পেসারের। বিশেষ করে বিশ্বকাপে সেরা পেসারদের টপকে নিজের নাম সবার ওপরে রাখবেন এমনটাই হয়তো চাওয়া তাঁর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link