দ্য ম্যান উইদ গোল্ডেন আর্ম

হাতের লাঠিটা থরথর করে কাঁপছে। পুরো শরীর কাঁপছে – বাড়ছে বুকের ধুপধুপ! উত্তেজনায় শরীরের ভার ঠিকঠাক ধরে রাখতে পারছেন না তিনি। মানুষটা আসবে, লক্ষাধিক মানুষের ভীরে অধীর আগ্রহভরে তার জন্য ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। বৃদ্ধ মানুষটার চোখ ছলছল করছে জলে। তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে কয়েক বছর পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করলাম আমি- একজন সত্যিকার রাজপুত্র থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠার গল্প!

১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ। আশির দশকের অন্যান্য স্বভাবিক দিনগুলোর মতো দিনটা শুরু হলেও মধ্যবিত্ত কৃষি ব্যাংকের চাকুরে মাশরুর রেজা ও গৃহিণী শিরিন শারমিনের জন্য মোটেও স্বাভাবিক ছিলোনা সেদিন। এই দিনেই যে তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের। মা বাবা তাদের আদরের রাজপুত্র’র ডাক নাম দিয়েছিলেন ফয়সাল

মাগুরার সেই ছোট্ট ফয়সাল আজ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। বাবা মাশরুর রেজা মাগুরা জেলার ফুটবলার হওয়ায় তার একমাত্র ছেলেকেও চেয়েছিলেন ফুটবলার বানাতে। যেই ছেলে একটা সময়ে এসে ক্রিকেটে রাজ করবে তাঁকে কি আর ফুটবলে বেধে রাখা যায়! ছোটবেলা ফুটবল খেলে কাটলেও একটা সময়ে এসে ক্রিকেটই হয়ে উঠে তার ধ্যান ধারণা।

__________________

খুব সম্ভবত ক্লাস টু কিংবা থ্রি তে পড়ি। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশের দোকানটায় বই নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ি। টিভিতে তখন বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের খেলা চলছিলো- বোলিংয়ে বাংলাদেশ। নতুন একটা ছেলে বোলিং করছে; আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে নেই। পত্রিকা পড়ার অভ্যেস তখনো হয়ে উঠেনি। ঘরোয়া ক্রিকেটের খবরাখবর জানা ছিলো না আমার। তবে তার বোলিং স্টাইল একেবারে আলাদা, এর আগে কোন স্পিন বোলারকে এই অ্যাকশনে বোলিং করতে দেখিনি।

পেস বোলিং অলরাউন্ডার ফরহাদ রেজার সাথে সেদিন হ্যাংলা পাতলা গড়নের সেই ছেলেটিরও অভিষেক হয়েছিলো৷ বল হাতে ৩৯ রানের বিনিময়ে এলটন চিগুম্বুরার উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও করেন ৩০ রান। ফরহাদ রেজার অভিষেক ম্যাচে ফিফটি এবং শাহরিয়ার নাফিসের সেঞ্চুরিতে সে ম্যাচ বাংলাদেশ জিতলেও সিরিজ হারে ৩-২ ব্যবধানে। শুরুতেই তাকে বোলিং জানা ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে খেলতে হয় কারণ রফিক আর রাজ্জাক থাকায় বাঁহাতি স্পিনের সার্ভিস খুব বেশি প্রয়োজন পড়েনি। টেস্ট শুরু করে ব্যাটিং জানা বোলার হিসেবে। প্রথম কয়েক ম্যাচ তো লোয়ার মিডল অর্ডারেই ব্যাট করেছিলেন।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ব্যাটে বলে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যেভাবে পারফর্ম করে গেছেন তা বোধকরি বাংলাদেশ ক্রিকেটে আর কারো পক্ষেই সম্ভবপর হয়নি। সাকিবের ধারাবাহিকতা ছিলো তৎকালীন বাংলাদেশের হয়ে খেলা যেকোন খেলোয়াড়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ধারাবাহিকতা আর বাংলাদেশের ক্রিকেটার যেনো পৃথিবীর দুই বিপরীত গোলার্ধে বাস করতো।

হাবিবুল বাশার, মেহরাব হোসেন অপি, আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফিস, অলক কাপালি, নাফিস ইকবাল, নাজিম উদ্দীন, আফতাব আহমেদ- বহুজনকে নিয়েই প্রত্যাশা ছিলো অনেক। কিন্তু কয়েকটা ম্যাচ খেলেই তারা নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছেন। উপরের নামগুলোর সবাই ব্যাটসম্যান হলেও সাকিব এক্ষেত্রেও ছিলেন ব্যতিক্রম। ব্যাট বল দুটাতেই সমানভাবে অবধান রাখতে সক্ষম। সাকিব ছাড়া বোধকরি আর কারো উপর প্রত্যাশার এতো ছাপ পড়েনি। ব্যাটে বলে সমানতালে পারফর্ম করেই সবার নজর কাড়েন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার।

__________________

যদি প্রশ্ন করা হয়, বর্তমান বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিঙ্গেল বের করে খেলেন কোন কোন ব্যাটসম্যান? তবে দু’টা নামই সবার উপরে থাকবে৷ আর সেটা হচ্ছে সাকিব ও মুশফিক। ক্যারিয়ারের শুরুতে মুশফিক যথেষ্ট ডট খেলতো। একটা সময়ে এসে সেও তার এই উইকনেস টা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সাকিব সিঙ্গেলস বের করে করে খেলতে পারতেন।

সিঙ্গেলস বের করে খেলা-ই সাকিবের ব্যাটিংয়ের প্রধান শক্তি। উনি যখন মাঠে নামেন তখন আপনার কাছে মাঠ অনেক বড় মনে হতে পারে। দু’য়েকটা ওভারে বাউন্ডারি না আসলেও উইকেটে থাকলে যেভাবেই হোক রান আসবেই। রানিং বিট্যুইন দ্যা উইকেটেও উনি দুর্দান্ত। তামিম মুশির মতো ন্যাচারাল ব্যাটসম্যান না হলেও সাকিব স্কুপ শট অনেক ভাল খেলেন৷ প্রিয় শট খেলায় অনেকবার আউট হবার দরুন তার ব্যাটে স্কুপ শট এখন আর দেখা যায় না। সাকিব মাঠে নামবেন, তামিম মুশির মতো ট্রেডমার্ক শট না খেললো যেকোনো ভাবেই তিনি রান করেন- দিনশেষে স্কোরটাই ম্যাটার করে।

বোলার সাকিবকে বিচার করতে গেলে সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো তার অ্যাক্যুরেসি। টানা একই লাইন লেংথ বজায় রেখে বল করে যেতে পারেন। সত্যিকার অর্থেই সাকিবের বলে টার্ন, বাউন্স কোনটাই খুব বেশি নেই। এমন একটা অ্যাক্যুরেসি বজায় রেখে বল করবে যে লেংথে খেলতে ব্যাটসম্যানের সমস্যা হয়।

যেই লেন্থে বল করে বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি দিয়েছেন পরের বলটাও ঠিক একই লেংথে করে উইকেট নেয়ার অহরহ রেকর্ড তার আছে- পার্থক্য টা শুধু ভেরিয়েশনে। বলের লাইন একই হলেও বলের পেস খানিকটা কমিয়ে বা বাড়িয়ে ব্যাটসম্যান কে বোকা বানাতে যথেষ্ট পারদর্শী। এক সময়ে তার আর্ম বলগুলো ছিলো মরণফাঁদ। তার আর্ম বলগুলো এতটাই কার্যকরী ছিলো যে, অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ম্যাথু হেইডেন তাকে, ‘দ্য ম্যান উইথ গোল্ডেন আর্ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মাশরাফির ইনজুরিতে হুট করে মাঠের মধ্যেই পেলেন দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। অধিনায়ক হিসেবে যথেষ্ট এটাকিং এবং ইনোভেটিভ। ফিল্ড প্লেসমেন্টে সাকিব বাংলাদেশের যেকোনো ক্যাপ্টেনের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকবেন। অনফিল্ডেও সাকিব যেকারো থেকে ঢের এগিয়ে থাকবেন। তবে খেলাটা যেহেতু ক্রিকেট অনফিল্ডের পাশাপাশি অফ ফিল্ডেও অধিনায়কদের মুন্সীয়ানার পরিচয় দিতে হয়। সেক্ষেত্রে সাকিব মাশরাফি, হাবিবুল বাশার থেকেও পিছিয়ে থাকবেন। সাকিবের অধিনায়কত্বে আমরা নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ করেছি, এশিয়া কাপের ফাইনালে গিয়েছি।

__________________

সাকিবের কোন কোন পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলা যায়? বলাটাই বোধহয় বোকামি হবে। সেটা তো কতজনই বলে- বলেছে, বলবে। আজ অনুভূতির কথা বলব। ক্রীড়া জগতে বাংলাদেশের নাম অন্যান্য সব দেশের থেকে উপরে দেখেছিলাম প্রথম কবে? খুব সম্ভবত সেই ২০০৯ এ যখন আইসিসি বেস্ট অলরাউন্ডার র‌্যাংকিং প্রকাশ করল তখন দেশের পতাকাটা সবার উপরে দেখেছিলাম এই মানুষটার জন্য। এর আগে কে বিশ্বাস করত আমাদের এই ছোট্ট দেশ থেকে এও সম্ভব!

বাংলাদেশ তখন বছরের পর বছর র‌্যাংকিং এর তলানীতে থাকা দেশ। লজ্জার রেকর্ডে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এই দেশ থেকে দুই একজন ভাল খেলোয়াড় বের হওয়ায়ই যেখানে ভাগ্য, চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা লাগে একজন প্লেয়ার বের করে আনতে, সেখানে সব দেশের এত বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের পিছনে ফেলে সবার উপরে উঠে আসাও সম্ভব? তার উপর খুব বেশি খেলার সুযোগ পাওয়া যায় না- পেলেও দল জিতে না। একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে তো অসম্ভব হওয়ার কথা ! কিন্তু কিছু কিছু অসম্ভব কে সম্ভব করার জন্যেও কিছু মানুষের জন্ম হয়! লজ্জার রেকর্ড ভেঙে বিশ্বসেরা হতে শিখিয়েছেন এই সাকিব-ই!

__________________

আচ্ছা তা না হয় হওয়া গেল। কতজনই তো এক নম্বর হয়। ক্যালিস ওয়ানডেতে এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়েছেন, টেস্টেও হয়েছেন। কিন্তু যেই ইতিহাস পৃথিবীর কারো পক্ষে করা সম্ভব হয়নি তা কি করা সম্ভব? তিন ফরম্যাটে একই সাথে এক নম্বরে উঠে আসাও কি সম্ভব? বিশেষ করে টেস্টে! সেই অসাধ্য সাধন করেছেন এই সাকিব-ই৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে একই সাথে টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তে সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে যতজন ক্রিকেটার দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ ছাড়াই সাকিবকে সেরা বলা যায়। হাটি হাটি পা পা করে যখন এদেশের ক্রিকেটের প্রসার ঘটেছে সেই থেকে শুরু করে আজ অব্দি সাকিব-ই দেশসেরা ক্রিকেটার। ক্রিকেট ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই এমন একজন ক্রিকেটারের নাম বলতে যে কিনা সাকিবের মতো ব্যাটিং-বোলিংয়ে একদম সমান এপোর্ট দিতে পেরেছেন! স্যার গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খান, জ্যাক ক্যালিস বা হালের শেন ওয়াটসন বা বেন স্টোকস অনেক গুলো নাম বলে ফেললাম।

এমন একজনের নাম জানতে চাই যার কাছ থেকে দল দুই ক্ষেত্রেই ব্যাটিং-বোলিংয়ে সমান পারফরম্যান্স এক্সেপ্ট করতো! ক্যালিসের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে তাকে বিরাট বড় অলরাউন্ডার মনে হবে৷ কিন্তু, ব্যাটিং ক্যালিসকেই ছোটবেলা থেকে চিনি, যেকিনা দলের প্রয়োজনে পার্টটাইম বল করতো। ডোনাল্ড, পোলক, এন্টিনি, স্টেইন, মরকেলদের ভীড়ে ক্যালিস প্রতিবারই ব্যাটসম্যান হিসেবে মাথায় আসছে।

শেন ওয়াটসনের বেলায় আসুন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি এর ভীড়ে তারও ব্যাটিং টাই মাথায় আসবে। সাকিবের ব্যাপারটা এখানে একেবারে আলাদা। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে সাকিব, বোলিংয়ে সাকিব। তার আলাদা কোন পরিচয় বের করতে পারবেন না। আমাদের ব্যাটিংয়ে তামিম, মুশফিক, রিয়াদ আছেন। তবুও আমরা সাকিবের ব্যাটিং মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখি। বোলিংয়েও তিনি সেরা পারফরমার। এরকম ইম্প্যাক্ট রাখা প্লেয়ার গোটা ক্রিকেট বিশ্বে কয়জন আছে!

__________________

আমি সাকিবের ফ্যান নই। সাকিব ব্যাট করতে নামলে বা বোলিং করার সময়েও এক্সট্রা কোনধরনের অনুভূতি আসেনা। একটা সময়ে সাকিবকে নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছি। সাকিবকে নিয়ে সমালোচনা আলোচনার অন্ত নেই। ক্যারিয়ারের কয়েকবছর পর থেকেই মানুষজন সাকিবকে নিয়ে নানা ধরণের মন্তব্য করে আসছে। সাকিবকে অনেকেই সীমাবদ্ধ একজন মানুষ মনে করতে পারেন না। তারা প্রতিম্যাচেই ভাবে সাকিব ম্যাচ জিতিয়ে দিয়ে যাবে।

সে জানে কোহলির মতো ব্যাটিং করতে পারবেনা, মুরালি, ওয়ার্নের মতো বলে স্পিন করাতে পারবেনা। তবুও সে ব্যাটিং বোলিং দুই বিভাগেই সমানভাবে অবধান রাখতে পারবে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারিনা বলেই আমাদের মনে জমে উঠে ক্ষোভে। সমালোচনার তীর নিয়ে এগিয়ে আসি তার দিকে। মানুষজন সাকিবের যতোই সমালোচনা করুক না কেন, প্রতিটা সমালোচনা প্রতিটা শাস্তি প্রতিটা আঘাত তাকে কেবল সামনের দিকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে।

আমরা উদ্ধতস্বভাবের সাকিবকে দেখেছি। ড্রেসিংরুমে তোয়ালের উপর স্পর্শকাতর জায়গায় অপ্রীতিকর ইশারা করতে দেখেছি। খুলনায় ওহাব রিয়াজের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়াতে দেখেছি। বেন স্টোক্সকে আউট করে ঐতিহাসিক সেই স্যালুট উদযাপন দেখেছি। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে উদোম শরীরের ক্ষ্যাপাটে সাকিবকে দেখেছি। মোড়লদের বিপক্ষে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে বেয়াদব ট্যাগ পাওয়া সাকিবকে দেখেছি। ২০০৬ থেকে ২০২০, গত ১৪ বছরে আর একটা সাকিবের জন্ম এই বাংলাদেশ দিতে পেরেছে?

প্রতি দশক পরপর ক্রিকেট ইতিহাসে একজন বোথাম, ইমরান, ক্যালিসের জন্ম হয়। গত এক দশকে ক্রিকেটবিশ্ব একজন সাকিবের জন্ম দিতে পেরেছে? সাকিবরা প্রতি দশকে আসেনা, শতবর্ষ সাধণার ফল একজন সাকিব। আমরা কতই না ভাগ্যবান একজন সাকিব আল হাসানের দেশে জন্ম নিয়েছি। আমরা এতোটাই ভাগ্যবান যে মাঠে বসে, টিভি সেটের সামনে বসে সরাসরি সাকিবের খেলা দেখতে পারছি। অথচ সাকিবের সাফল্যে যতোটা না আমরা খুশি হই তার চেয়েও বহুগুণ তাঁর সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে। একটু একটু করে যে বিশ্বাস আর আস্থার জন্ম দিচ্ছে তার সবচেয়ে আস্থাভাজন নামটাও সাকিব। গত কয়েকবছর ধরে অলরাউন্ডারের শীর্ষস্থানটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা এই ক্রিকেটারকে পরিসংখ্যান দিয়ে কখনোই বিচার করা সম্ভব না- ট্রফি দিয়ে তো নয়-ই!

__________________

২০০৭ সালের বিশ্বকাপে জহির-হরভজনদের বিপক্ষে ছিপছিপে শরীরের ২০ বছর বয়সী সাকিবের ম্যাচ উইনিং ফিফটি থেকে শুরু করে মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬৯ বলে ৯২ রানে ম্যাচ জিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল খেলা। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করা সিরিজে দলকে দিয়েছেন সামনে থেকে নেতৃত্ব – নিজে হয়েছিলেন সিরিজ সেরা।

শচীনের শততম সেঞ্চুরির ম্যাচের কথা মনে আছে! একটা সময়ে ২৯০ রান তাড়া করা যখন অসাধ্য মনে হচ্ছিল ঠিক তখনই পাঠান, অশ্বিনদের বিপক্ষে খেলেন ৩১ বলে ৪৯ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। সে ম্যাচটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা জয়ের একটি ছিল। টেস্ট ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি বা ম্যাচে ১০ উইকেট পাওয়া সবসময়ই স্পেশাল কিছু। কিন্তু সেটা যদি একই ম্যাচে হয়ে যায় তবে সেটা স্পেশালের চেয়েও বেশি কিছু।

২০১৪ সালে খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই স্পেশাল অর্জনটাই করে দেখিয়েছন আমাদের সাকিব। যার আগে এই কীর্তি ছিলো শুধুমাত্র দুজন প্লেয়ারের- স্যার ইয়ান বোথাম এবং ইমরান খান। ২০১৫ সালে তো ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র প্লেয়ার হিসেবে তিন ফরমেটেই হয়েছেন আইসিসির সেরা অলরাউন্ডার। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স তো সবার-ই মূখস্ত থাকার কথা!

__________________

২০১৫ তে পাকিস্তান যখন বাংলাদেশ সফরে আসে সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের ফেভারিট দাবি করায় তখনকার অনেক ক্রিকেটবোদ্ধাই নাক ছিটকিনি দিয়েছেন। পাকিস্তান কে ৩-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে সাকিব প্রমাণ করেছেন যে আমরাই ফেভারিট ছিলাম। বন্ধ করে দিয়েছেন সমালোচকদের মুখ। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সেঞ্চুরির কথা নিশ্চয়ই ভুলার মতো নয়।

সে বছরের শুরুতেই কিউই কন্ডিশনে করেছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ডাবল সেঞ্চুরি থেকেই কিনা উজ্জীবিত হয়ে ধ্বংসাস্তপ থেকে মাহমুদউল্লাহ কে নিয়ে গড়েছেন রেকর্ড জুটি। সেই সাথে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পৌঁছায় চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে মিরপুরে ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক, নিদাহাস ট্রফির সেই ক্যাপ্টেন সাকিবকে ট্রফি দিয়ে বিচার করা যায়? গেলো বছর আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স তো সবার-ই মূখস্ত থাকার কথা! সাকিব প্রমাণ করেছেন কেনো তাঁকে বলা হয় ‘দ্য ওয়ান ম্যান আর্মি!’

__________________

নব্বইয়ের জেনারেশন বা তার পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ রবিনহুড হতো চাইতো, সালমান শাহ হতে চাইতো। সালমান খান, শাহরুখ খানের মতো পর্দার হিরো হতে চাইতো। সেই দিন বদলেছে যে অনেকদিন হলো। এখন আমরা সবাই একজন সাকিব হতে চাই। ছাত্র-ছাত্রী চায়, শিক্ষক চায়, ভার্সিটির বড় ভাইয়েরাও একেকজন সাকিব হতে চায়! শতশত খারাপ খবর, দুর্নীতি আর অনিয়মের দেশে একজন সাকিব তো আকাশের চাঁদ-ই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link