লড়াইয়ের মানে, বিনয়ের মানে

‘১০ টি ফেরারি, ২০ টি হীরার ঘড়ি, দু’টো প্লেন চাইলেই কিনতে পারি। কিন্তু কেন কিনতে চাইবো আমি? আমাকে ওইসব টানে না। এর চেয়ে জীবনে যা পেয়েছি তার কিছুটা অন্যদের দিতে পারলেই আমি বরং খুঁজে পাই পরম তৃপ্তি’ - কথাগুলো একজন ফুটবলারের। চিনতে পেরেছেন তাঁকে? হয়তো পেরেছেন, হয়তো বা স্মৃতিতে কিছু আসেনি। না চিনতে পারলে জেনে নিন, এই ফুটবলারের নাম সাদিও মানে।

‘১০ টি ফেরারি, ২০ টি হীরার ঘড়ি, দু’টো প্লেন চাইলেই কিনতে পারি। কিন্তু কেন কিনতে চাইবো আমি? আমাকে ওইসব টানে না। এর চেয়ে জীবনে যা পেয়েছি তার কিছুটা অন্যদের দিতে পারলেই আমি বরং খুঁজে পাই পরম তৃপ্তি’ – কথাগুলো একজন ফুটবলারের। চিনতে পেরেছেন তাঁকে? হয়তো পেরেছেন, হয়তো বা স্মৃতিতে কিছু আসেনি। না চিনতে পারলে জেনে নিন, এই ফুটবলারের নাম সাদিও মানে।

লিভারপুলের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মাতানো সাদিও মানে সেনেগালের নাগরিক। ১৯৯২ সালের ১০ই এপ্রিল সেনেগালের সেদিউ শহরে জন্ম হয়েছিল সাদিও মানে’র। ছোটবেলাটা খুব মধুর ছিল না তার। বেড়ে উঠেছিলেন বাম্বালি নামের একটি গ্রামে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা-ও একদম ভালো ছিল না। এমনকি স্কুলে পাঠানোর মত অর্থও ছিল না মানে’র পরিবারের কাছে।

তবে খুব ছোট থেকেই ফুটবলের নেশা পেয়ে বসে মানেকে। মানের শরীরে সবসময় কাপড় না থাকলেও পায়ে ফুটবল থাকতো। খেলার সনয় মানেকে আর আটকে রাখা যেত না বাসাতে। ফুটবলের প্রতি মানের প্রভূত আকর্ষণ থাকলেও প্রথমদিকে পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি। পরিবার চেয়েছিল মানে ধর্মের সেবায় নিয়োজিত থাকুক কিন্তু ফুটবল থেকে মানেকে কোনোভাবেই সরানো যায় নি।

২০০২ সালে যেবার সেনেগাল ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করল, তখন ফ্রান্স ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। থিঁয়েরি অরি, জিনেদিন জিদান-দের মত তারকা’রা ছিল ফ্রান্সের একাদশে। কিন্তু গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের মুখোমুখি হওয়া সেনেগাল সেদিন ১-০ গোলে জিতে গিয়েছিল। ফ্রান্সের বিপক্ষে সেনেগালের সেই ঐতিহাসিক জয় খুব কাছ থেকে দেখেছিল সাদিও মানে। এমনিতেই ধ্যানজ্ঞানই ছিল ফুটবল, এমন জয় তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।

সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ‘জেনারেশন ফুট’ নামের এক ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি’র মাধ্যমে শুরু হয় মানে’র স্বপ্নের পথে ছোঁটা। ট্রায়ালের শুরুতে মানের জামা-কাপড় দেখে খোঁচা দেয়া কোচ ট্রায়ালের পর মানের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেদিনই তাকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে নেন।

জেনারেশন ফুটে থাকাকালীন মানে’র উপর নজর পড়ে ফরাসি স্কাউটদের। তাকে নিয়ে আসা হয় ফরাসি ক্লাব ‘মেজ’-এ। মাত্র পনের বছর বয়সেই মেজ-এর হয়ে মানে’র পেশাদার ফুটবলে পথ চলা শুরু। পরে অবশ্য মেজ থেকে চার মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে অস্ট্রিয়ান ক্লাব রেড বুল সাল্জবার্গে নাম লেখান সাদিও মানে।

সাল্জবার্গ দলের হয়ে অস্ট্রিয়ান লিগে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন মানে। ৮০ ম্যাচে ৪২ গোল করেছিলেন; জিতেছিলেন অস্ট্রিয়ান কাপ, অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা। এরপরের গল্পটি শুধুই মানে’র। বিশ্বের অন্যতম সেরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে খেলার সুযোগ পান তিনি, ১২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে রেড বুল স্যাল্জবার্গ থেকে ইংলিশ ক্লাব সাউদাম্পটনে যোগ দেন।

সাউদাম্পটনে এসে শুরু থেকেই নিজের ঝলক দেখাতে শুরু করেন সাদিও মানে। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে সাউদাম্পটনের হয়ে নিয়মিত পারফর্ম করতে থাকেন। ২০১৫ সালের ১৬ মে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ৬-১ গোলে জয় পায় সাউদাম্পটন। সেদিন মাত্র দুই মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডের মধ্যেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন মানে, যেটি আজ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিক। ২০১৫-১৭ মৌসুমে সবমিলিয়ে ১৫টি গোল করে সাউদাম্পটনের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন সাদিও মানে।

ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পুরষ্কার দ্রুতই পেয়ে যান সাদিও মানে। ইংলিশ লীগেরই জায়ান্ট ক্লাব লিভারপুল তৎকালীন রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে দলে ভেড়ায় তাকে। লিভারপুলের হয়েই নিজের ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি সময় শুরু হয় মানে’র৷ আরেক আফ্রিকান ফুটবলার মোহামেদ সালাহ এবং ব্রাজিলিয়ান কৌতিনহো, ফিরমিনহোদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিধ্বংসী এক আক্রমণভাগ। কৌতিনহো পরে অবশ্য দল ছাড়লেও ধার কমেনি লিভারপুলের; মানে,সালাহ, ফিরমিনো হয়ে উঠেছিলেন সেসময়ের অন্যতম ভয়ংকর ‘অ্যাটাকিং ট্রায়ো’।

লিভারপুলের হয়ে জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ; দুইবার ফাইনাল খেলে একবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপাও। জায়গা পেয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের টিম অব দ্য ইয়ারে, যৌথভাবে জিতেছিলেন ঘরোয়া লীগের গোল্ডেন বুট। সেনেগালের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে গোল করার কৃতিত্বও রয়েছে মানে’র অর্জনের খাতায়। জাতীয় দল সেনেগালের হয়েও নেহাৎ কম করেননি মানে। ক্লাব সতীর্থ সালাহ’র মিশর-কে হারিয়ে জিতেছেন আফ্রিকান নেশন্স কাপ। বাছাই পর্ব টপকে বিশ্বকাপ খেলারও সুযোগ পেয়েছে সাদিও মানে’র নেতৃত্বাধীন সেনেগাল।

ব্যক্তিগত জীবনে মানে অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। ইউরোপের অন্যতম সেরা একটি ক্লাবের খেলোয়াড়, কিংবা বিশ্বের অন্যতম সেরা অ্যাটাকার হওয়া, এসব বিষয় নিয়ে মোটেও ভাবেন না তিনি। ভুলেননি নিজের অতীতকে, ভুলে যাননি ছোটবেলায় প্রতিবেশীদের উপকারের কথাও। তার গ্রামের মানুষদের সহায়তা করেন সাধ্যমতো। আফ্রিকায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখতে চেষ্টা করেন সাদিও মানে।

রোনালদো কিংবা মেসি’র মতন বড় কিছু হয়তো হতে পারেননি সাদিও মানে তবে আদর্শ হয়ে উঠেছেন অনেক অনাগত ফুটবলারের। এতো সাফল্য, অর্থকড়ির মাঝেও এক বিন্দু অহংকার দেখা যায় নি তার মাঝে। অন্যান্য ফুটবলাররা যেখানে আয়েশী জীবন উদযাপনে মত্ত, মানে সেখানে ব্যতিক্রম। ভাঙা ডিসপ্লের একটি পুরনো ফোন আর মুখভর্তি অমায়িক হাসিতেই এই ফুটবলার তুষ্ট। অর্থের মোহ বা বিলাসিতার লোভ তো সবাইকে ছুঁতে পারে না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...