দ্য নেম ইজ বন্ড… শেন বন্ড!

খ্যাতনামা স্পেশাল এজেন্ট বন্ডের মারদাঙ্গা সিনেমার মতই অ্যাকশনে ভরপুর ছিল নিউজিল্যান্ডের স্পিডস্টার বন্ডের ক্যারিয়ার। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘাতক ‘ইনজুরি’। ইনজুরি বাধায় ক্যারিয়ারে বার বার ছন্দপতন না ঘটলে হয়ত ক্রিকেট ইতিহাসের ‘সর্বকালের সেরা’ ফাস্ট বোলারদের একজন হতে পারতেন তিনি।

ফাস্ট, ফিউরিয়াস, ড্যাশিং! এককথায় শেন বন্ডের বর্ণনা দিতে এই তিনটি বিশেষণই যথেষ্ট। রূপালি পর্দায় জেমস বন্ড যেভাবে কৌশলে তার শত্রুদের ধরাশায়ী করেন, ক্রিকেট মাঠে শেন বন্ড ঠিক সেভাবেই আগুনঝরা ফাস্ট বোলিংয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করতেন।

খ্যাতনামা স্পেশাল এজেন্ট বন্ডের মারদাঙ্গা সিনেমার মতই অ্যাকশনে ভরপুর ছিল নিউজিল্যান্ডের স্পিডস্টার বন্ডের ক্যারিয়ার। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘাতক ‘ইনজুরি’। ইনজুরি বাধায় ক্যারিয়ারে বার বার ছন্দপতন না ঘটলে হয়ত ক্রিকেট ইতিহাসের ‘সর্বকালের সেরা’ ফাস্ট বোলারদের একজন হতে পারতেন তিনি।

বন্ড ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি পরবর্তী যুগে নিউজিল্যান্ডের অবিসংবাদিত সেরা ও সফলতম ফাস্ট বোলার, একজন ভয়ঙ্কর জাত উইকেটশিকারি। তাঁর আক্রমণাত্মক শারীরিক ভাষা এবং হার না মানা লড়াকু মানসিকতা তাঁকে সবসময় প্রতিপক্ষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রাখত। যেকোন উইকেটে গতির ঝড় তুলে ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরাতে পারতেন বন্ড।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ঘন্টায় ১৪৫ কিমি গতিতে নিয়মিত বোলিং করতেন তিনি। ২০০১-০২ মৌসুমে তিনি প্রথমবারের মত ঘন্টায় ১৫০ কিমির চেয়ে বেশি গতিতে বল করার রেকর্ড গড়েছিলেন। তাঁর সবচাইতে বেশি গতির ডেলিভারিটি ছিল ২০০৩ ওয়ার্ল্ড কাপে ভারতের বিপক্ষে ঘন্টায় ১৫৬.৪ কিমি।

বন্ডের শুধু দুরন্ত গতিই ছিল না, সাথে ছিল দারুণ অ্যাকুরেসি ও কন্ট্রোল। অধিকাংশ ফাস্ট বোলারদের যেটা ছিল না কিন্তু বন্ডের ছিল, তা হল একই লাইন এবং লেংথে ক্রমাগত বোলিং করে যাবার ক্ষমতা। তাঁর নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থের জন্য মাঝেমধ্যে তাঁকে ম্যাকগ্রার সাথেও তুলনা করা হত।

বোলিংয়ের সময় খুব এটা লম্বা রানআপ নিতেন না বন্ড। তার বোলিং অ্যাকশনটাও ছিল দারুণ সাবলীল ও চমৎকার অ্যাথলেটিক। অধিকাংশ সময় ঘন্টায় ১৫০ কিমি গতির আশেপাশে বোলিং করা বন্ড বলকে সুইং করাতে পারতেন দুদিকেই। তবে ইনসুইংটা ছিল ন্যাচারাল। পাশাপাশি পুরোনো বলে রিভার্স সুইংয়েও পারদর্শী ছিলেন তিনি। এক্সপ্রেস গতির সাথে যখন লেট সুইং যোগ হত, তখন ব্যাটসম্যানদের কাছে বন্ড হয়ে উঠতেন রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’!

যেকোন উইকেটেই বলকে এক্সট্রা লিফট করাতে পারতেন বন্ড। তাঁর গুড লেন্থে পড়ে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা ডেলিভারিগুলো পৃথিবীর যেকোন পিচে যেকোন ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য ছিল যথেষ্ট। তাছাড়া বন্ডের বোলিংয়ের সেরা অস্ত্র দুরন্ত গতির ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কারে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলাটা ছিল ক্রিকেট মাঠের নিয়মিত দৃশ্য। তাঁর লেট ইনসুইং করে ভেতরে ঢোকা ইয়র্কারগুলো যেসব ব্যাটসম্যান ফেস করেছেন একমাত্র তারাই বুঝেছেন কতটা বিপজ্জনক ও ভয়ংকর ছিল সেগুলো।

সুতরাং গতি, সুইং, নিখুঁত লাইন-লেন্থ, বাউন্সার এবং ইয়র্কার মিলিয়ে বন্ড ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার। ফর্মের তুঙ্গে থাকা বন্ড বিশ্বের যেকোন ব্যাটিং লাইনআপকে একা হাতে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। আগ্রাসী বোলিংয়ে বন্ডের মত এভাবে ব্যাটসম্যানদের ওপর ডমিনেট করতে খুব কম বোলারকেই দেখা গেছে; বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে।

বন্ডকে বলা হত ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ কেননা বড় দলের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বন্ড একটু বেশিই ভাল খেলতেন। মজার ব্যাপার হল, বন্ড সবসময় তাঁর সেরাটা জমিয়ে রাখতেন ব্ল্যাক ক্যাপদের ‘চেনা শত্রু’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলার জন্য। ওয়ানডেতে অজিদের বিপক্ষে বন্ড মাত্র ১৫.৭৯ গড়ে নিয়েছেন ৪৪ উইকেট! ৫ উইকেট আছে ৩ বার! একটা ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক রিকি পন্টিংকে টানা ৬ বার আউট করে নিজের প্রিয় শিকার অর্থাৎ ‘বানি’তে পরিণত করেছিলেন বন্ড।

ক্যারিয়ার ছোট হলেও টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দারুণ সফল ছিলেন ‘ইনজুরিপ্রবণ’ এই ফাস্ট বোলার। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই অবিশ্বাস্য রকমের ধারাবাহিক বন্ডের টেস্ট অভিষেক ২০০১-০২ মৌসুমে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তবে অভিষেকের পর থেকে নয় বছরে মাত্র ১৮ টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি! যেটা তাঁর ক্যালিবারের একজন বোলারের জন্য একই সাথে হতাশা এবং আক্ষেপের।

১৮ টেস্টে ৩২ ইনিংসে মাত্র ২২.০৯ গড়ে আর ৩৮.৭ স্ট্রাইক রেটে বন্ডের উইকেটসংখ্যা ৮৭টি। টেস্ট ইতিহাসে ন্যুনতম ২৫০০ বল করা বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটটাও (৩৮.৭) তাঁর দখলে। মাত্র ৩৪.১ স্ট্রাইক রেট নিয়ে এক নম্বরে আছেন উনিশ শতকের কিংবদন্তি মিডিয়াম পেসার জর্জ লোহম্যান।

ওয়ানডে ফরম্যাটে বন্ডের সাফল্যের পাল্লা আরো ভারি। ৮২ ওয়ানডেতে ৮০ ইনিংসে বল হাতে নিয়ে মাত্র ২০.৮৮ গড়ে এবং ২৯.২ স্ট্রাইক রেটে তাঁর শিকার ১৪৭ উইকেট। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন্তত ৩০০০ বল করেছেন এমন বোলারদের মধ্যে চতুর্থ সেরা বোলিং গড় এবং তৃতীয় সেরা স্ট্রাইক রেট বন্ডের। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম ১০০ উইকেটের (৫৪ ম্যাচ) রেকর্ডটিও বন্ডের দখলে।

বন্ডের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়, ২০০১-০২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ‘ভিবি সিরিজ’কে। গোটা সিরিজ জুড়েই অসাধারণ বোলিং করা বন্ড ৮ ম্যাচে মাত্র ১৬.৩৮ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সিরিজসেরা। অথচ ওটাই ছিল বন্ডের অভিষেক সিরিজ!

২০০৩ বিশ্বকাপটা ছিল বন্ডের ক্যারিয়ারের সবচাইতে স্মরণীয় ও উজ্জ্বলতম অধ্যায়। পুরো টুর্নামেন্টেই তিনি ছিলেন দারুণ ধারাবাহিক। ৮ ম্যাচে মাত্র ১৭.৯৪ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট; হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের ৫ম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এছাড়া ২০০৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার পেছনেও ‘উইকেটশিকারি’ বোলার হিসেবে বন্ডের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপ মিলিয়ে ১৬ ম্যাচে মাত্র ১৭.২৩ গড়ে বন্ডের শিকার ৩০ উইকেট। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপে বন্ডের ইকোনমি রেট মাত্র ৩.৫১! যা একজন ফাস্ট বোলারের জন্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বুলাওয়েতে ভারতের বিপক্ষে একটি ওয়ানডেতে মাত্র ১৯ রানে ৬ উইকেট শিকার করেছিলেন বন্ড যেটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার। বিধ্বংসী এক স্পেলে একে একে রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, মোহাম্মদ কাইফ, বীরেন্দর শেবাগ, বেণুগোপাল রাও এবং ইরফান পাঠানকে আউট করে ভারতের ‘তথাকথিত’ বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপকে বলতে গেলে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন বন্ড। কিউই পেসারদের বোলিং তোপে সেদিন একটা সময় ভারতের স্কোর দাঁড়িয়েছিল ৪৪/৮!

এছাড়া ওয়ানডেতে বন্ডের আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স রয়েছে। সেগুলোর ভেতরে ২০০২ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫/২৫, ২০০৩ বিশ্বকাপে পোর্ট এলিজাবেথে একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ৬/২৩, ২০০৭ সালে ওয়েলিংটনে ৫/২৩ এবং ২০১০ সালে আবারও ওয়েলিংটনে ৪/২৬ (দুটোই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে) এই কয়েকটার কথা না বললেই নয়।

ওয়ানডেতে একবার হ্যাটট্রিকও করেছেন বন্ড; ২০০৭ সালে হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে। প্রতিপক্ষ কে হতে পারে বলুন তো? কে আবার? অস্ট্রেলিয়া!

২০০৮ সালে নিষিদ্ধ টি-টোয়েন্টি লিগ আইসিএলে যোগ দেয়ায় নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের (এনজেডসি) সাথে বন্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। ফলে প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।

২০০৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হোম সিরিজে শেষবারের মত জাতীয় দলে ডাক পান বন্ড। সেই সিরিজেই খেলেছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের বিদায়ী ম্যাচ। ডানেডিনে অনুষ্ঠিত সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৭ রানে পাঁচটি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রানে তিন উইকেট নিয়ে ‘ম্যাচ সেরা’ হয়ে বিদায় বেলাটাকেও রাঙিয়ে গিয়েছিলেন বন্ড।

২০০৯ সালের ডিসেম্বরেই মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট ক্রিকেটকে গুডবাই বলে দেন তিনি। টেস্ট ছাড়লেও আরো কিছুদিন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বন্ড; যদিও ইনজুরির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালের ১৩ মে এক রকম বাধ্য হয়েই সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন বন্ড।

ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, শেন বন্ড ছিলেন আমার দেখা সবচাইতে ভয়ংকর, আগ্রাসী ও বিস্ফোরক ফাস্ট বোলারদের একজন। ছন্দে থাকা বন্ড পৃথিবীর যেকোন ব্যাটসম্যানের জন্য ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। যখন শুনি ম্যাথু হেইডেনের মত কেউ নাকি বন্ডের তীব্র গতির ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কারের হাত থেকে পা বাঁচাতে বুটের ওপর ‘টো-গার্ড’ লাগিয়ে খেলতে নামতেন, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে ব্যাটসম্যানদের মনে ঠিক কতটুকু ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছিলেন তিনি।

শেষ করব বন্ডকে নিয়ে বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় একটি উক্তি দিয়ে – ‘নিউজিল্যান্ডের কাছে তিনি তাঁদের নতুন রিচার্ড হ্যাডলি, বাকি দুনিয়ার কাছে তিনি বন্ড, শেন বন্ড!’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...