সকালের সূর্য দেখে নাকি দিনের পুরোটা চেনা যায়। সেই সকালের সূর্য যত মিষ্টি রোদ মাখা হবে, দিনের শুরুটাও আপনার কাছে হবে ততটাই উপভোগ্য। ক্রিকেটেও এই প্রবাদকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না। ওপেনিং জুটি যত শক্তভাবে দাঁড়িয়ে যায়, দলের রান তত বাড়তে থাকে। আর উপভোগের প্রশ্ন এলে তো আমরা মারমার কাটকাট ক্রিকেটটাই বুঝে থাকি।
আর ওপেনিং জুটিতে চোখের শান্তি দেওয়া এই উপভোগ্য ক্রিকেটের ব্যাটন সনাথ জয়াসুরিয়া, হার্শেল গিবস, বীরেন্দর শেবাগের হাত ধরে এখন রোহিত শর্মার হাতে! কিন্ত, রোহিত শর্মা কি এমনই ছিলেন? ওয়ানডে ক্রিকেটের অন্যতম সফল কিংবা কারো কারো মতে যিনি ক্যারিয়ার শেষে হয়ে যেতে পারেন সর্বকালের সেরা ওপেনারদের একজন, ভারতীয় ক্রিকেট ইনিংসের সকালের সূর্য গড়ে দেওয়া সেই মানুষটার নিজের সকালটা আসলে ঠিক কেমন ছিল?
২০০৭ সালে ফিরে যাওয়া যাক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা সেবার অংশ নিয়েছিল হার্শাল গিবস, গ্রায়েম স্মিথ, এবিডি ভিলিয়ার্স, মার্ক বাউচার, শন পোলক, মাখায়া এনটিনি,মর্নে মরকেল, এলবি মরকেলের মত খেলোয়াড়দের নিয়ে। উড়ন্ত সেই স্বাগতিক প্রোটিয়াদের বিপক্ষে নামিয়ে দেওয়া হল ২০ বছরের এক যুবককে। এমনিতেই টালমাতাল ভারতীয় ক্রিকেট তখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দল পাঠিয়েছিল এক রকম জোর করেই, নতুন অধিনায়কের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে। সেই দলেই প্রথম রোহিত শর্মার অন্তর্ভুক্তি।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ম্যাচের কথা বলছিলাম। আজকের সেরা ওপেনার সে সময় অগাধ প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রথমবারের মত নীল জার্সিটা গায়ে চাপিয়ে ব্যাট হাতে নেমে পড়েছিল ৫ নম্বরে। শুরুটা যে একেবারে মন্দ হয়েছিল তা বলার উপায় নেই, মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথেই তো মহা গুরুত্বপূর্ণ এক জুটি তৈরিতে সঙ্গ দিয়েছিলেন সে সময়ের ২০ বছর বয়সী রোহিত।
এখন রোহিত শর্মাকে ব্যাট হাতে আমরা যেভাবে উদ্ভাবনী সব শটে গ্যালারি মাতিয়ে রাখতে দেখি, শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না মোটেও। উদ্ভাবনী তো নয়ই, বরং সেই ম্যাচে রোহিতের খেলা সবগুলো শটই ছিল বড্ড বেশি গতানুগতিক। তবে সেই ম্যাচেও মহারাষ্ট্রের ২০ বছর বয়সী তরুণ নজর কেড়েছিলেন অন্য জায়গাতে। একে তো অভিষেকের চাপ, তার ওপর নেমেছেন পাঁচ নম্বরে, উইকেটে তখন খোদ অধিনায়ক, তাতেও রোহিতের শরীরি ভাষায় চাপের লেশমাত্র বোঝা যাচ্ছিল না।
ঠাণ্ডা মাথায় গ্যাপ শট খেলে যেভাবে সিংগেল নিচ্ছিলেন তিনি, উইকেটের অপর প্রান্তে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি তার দলের নবাগত সদস্যের প্রতি ঠিক কতটা প্রসন্ন হচ্ছেন। মূলত এই সিংগেলের ফোয়ারাতে ধোনির সাথে রোহিতের পার্টনারশিপই ভারতকে সম্মানজনক স্কোর গড়তে সাহায্য করেছিল।
এ তো গেল অভিষেক ম্যাচের ব্যাটিং কীর্তির গল্প। ফিল্ডিং এও নিজের আগমনী বার্তা জানান দিয়েছিলেন রোহিত সে ম্যাচেই। বিশেষ করে জাস্টিন কেম্প কে যেভাবে রান আউট করেন তিনি, রোহিত শর্মা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- তিনি ক্রিকেটে ফুরিয়ে যেতে আসেননি।
সত্যি কথা বলতে, রোহিত শর্মার প্রতিভা নিয়ে কখনোই কারো কোন সন্দেহ ছিল না। ঘরোয়া থেকে জাতীয়, ভারতীয় ক্রিকেটে যে-ই রোহিত শর্মাকে ব্যাট হাতে দেখেছেন, বিনা বাক্য ব্যায়ে বলেছেন- এই ছেলেটি ক্রিকেটে একদিন রাজত্ব করবে। কিন্তু বললেই তো হবেনা, শুরুটা সবসময়ই কঠিন! উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখিয়ে অমোঘ নক্ষত্রের পতন তো আর কম দেখেনি ক্রিকেট!
সেই নক্ষত্রের পতনের সম্ভাবনাও দেখিয়েছেন রোহিত। শুরুটা করেছিলেন পাঁচ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে, কিন্তু মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে মোটেই ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না তিনি । সুন্দর শুরুর পর হারিয়ে ফেলছিলেন খেই, নামের পাশে বড় অঙ্কের দেখা মিলছিল না। এই কম রান দিয়ে কি আর ‘ব্লুজ’ দের দলে থাকা যায়? ফলাফল- দল থেকে ছিটকে পড়েন রোহিত।
অমিত সম্ভাবনা নিয়ে যার নীল জার্সিতে আসা, অভিষেকেই যে ঠান্ডা মাথায় দলের রান সম্মানজনক স্কোরে বাড়িয়ে নিতে অধিনায়ককে সঙ্গ দিয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের সমস্ত বিশ্লেষক যাকে বলে দিয়েছেন ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’ – সেই রোহিত শর্মার বাদ পড়তেও সময় লাগেনি! ক্রিকেট কতটা নিষ্ঠুর, তাই না?
তবে ক্রিকেট যদি এতটা নিষ্ঠুর হয়ে থাকে, রোহিত শর্মা ঠিক ততটাই স্নিগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন, নক্ষত্র হতেই! তবে এবার আর মিডল অর্ডারে নয়, ওপেনিংয়ে।
সাল ২০১৩, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। শিখর ধাওয়ানের সাথে রোহিত শর্মাকে সেবার প্রথমবারের মত ওপেনিংয়ে পাঠানো হয়। ইংলিশ কন্ডিশনে পাঁচ ম্যাচ খেলে রোহিত করেছিলেন ১৭৭ রান, যার মধ্যে দুটি ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস। সেই টুর্নামেন্টে রোহিত শর্মাকে যারা দেখেছিলেন, তারাই স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ওপেনিংয়ে বড় কিছুর বার্তা দিচ্ছেন রোহিত, এই পজিশনটাই আসলে তার জন্যে, তার খেলার ধরণের জন্যে!
এক প্রান্তে শিখর ধাওয়ান স্কিল আর রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে নিজের ভান্ডারে রাখা শট খেলছেন, অন্য প্রান্তের রোহিত তখন বলকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে খুশির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। তখন না জানলেও আমরা এখন জানি, ওপেনিং জোড়া হিসেবে রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান ভারতীয় ক্রিকেটকে তারপর আর কত অর্জনে ভাসাবেন! অর্জনের শুরুটাও কিন্তু ঐ টুর্নামেন্টেই, ভারতকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতাতে এই দুই ওপেনারের অবদান খাটো করে দেখার কোন সুযোগ আছে নাকি?
তবে রোহিত শর্মা নিজেকে চিনিয়েছেন সে বছরের অক্টোবরে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের কথা ধরা যাক। জয়পুরে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ভারতকে টার্গেট দিয়েছিল ৩৬০! বিরাট কোহলিকে সাথে নিয়ে রোহিত শর্মা ভারতকে সে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন ছয় ওভার আগে, মাত্র এক উইকেট হারিয়ে! রোহিত শর্মাকে দেখে বারবার আমরা যে ভাবি- ‘এভাবেও ব্যাট করা যায়’, সেই মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার পালা শুরু ঐ সিরিজেই।
১২৩ বল খেলে ১৪৪ রানের ইনিংসে ভারতকে যে ম্যাচে পাহাড় ডিঙিয়ে দিলেন তিনি, রোহিত শর্মা কি জানতেন এর চাইতেও বড় কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে এর পরেও? রোহিত শর্মা জানতেন কিনা আমরা জানিনা, কিন্তু রান চেজিংয়ের সেই মিরাকলে অনেকেই আরেকবার রোহিত শর্মার ক্রিকেট রাজত্বের ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছিল- ‘এভাবেও ব্যাট করা যায়!’
তবে অবাক হবার পালা শেষ হয়নি, রোহিতেরও শেষ হয়নি মন্ত্রমুগ্ধ করার পালা আর তাতে তিনি সময়ও নেননি বেশি।
সেই সিরিজেরই সাত নম্বর ওয়ানডে! অস্ট্রেলিয়ার পরাক্রমশালী বোলিং লাইনআপকে এক রকম মাটিতে নামিয়ে এনে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেন রোহিত। ১৫৮ বল, ২০৯ রান, স্ট্রাইক রেট ১৩২ – ‘এভাবেও ব্যাট করা যায়!’
সেই যে শুরু করলেন রোহিত, আর থামলেন না এরপর। ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচাইতে বড় নাম হয়ে যেতে থাকলেন আস্তে আস্তে। যুক্ত হতে থাকল একের পর এক অর্জন। আমরা জানি, রোহিত শর্মার হয়ত আমাদের অবাক করার পালা এখনও বাকি। কিন্তু এই যে ম্যাচের পর ম্যাচ যায়, রোহিত শর্মা একটি ম্যাচের জন্যেও, একটি বলের জন্যেও থামেন না, প্রতিটি বলই যেন ব্যাটে লেগে সুইট সাউন্ড তুলে উড়ে যায় গ্যালারিতে, এতটা ধারাবাহিক রোহিত শর্মা কি করে হলেন?
এই যে ওয়ানডে ক্রিকেটে একজন মানুষ একাই তিনটে ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলল,আপনি কি কখনও ভেবেছেন ঠিক কোন জিনিসটা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রোহিত শর্মাকে এতটা আগ্রাসী করেছে?
সত্যি কথা বলতে, রোহিত শর্মার আজকের সফলতার বীজ লুকিয়ে আছে তার শুরুর দিনগুলিতে। ম্যাচের পর ম্যাচ তিনি খেলেছেন মিডল অর্ডারে। হয়তো এই পজিশনটাতে নিজের নামের সাথে মানানসই ভাল করেননি, কিন্তু এই পজিশনে খেলাটা তাকে সাহায্য করেছে আজকের রোহিত শর্মা হতে। কিভাবে?
আপনি যদি রোহিতের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখে থাকেন, তবে খেয়াল করবেন তিনি ডট বল দিতে একদমই ইচ্ছুক নন। কোন একটি বলে হয়তো বাউন্ডারি নেওয়া যাচ্ছেনা, রোহিত শর্মা সেই বলটিকে নিতান্তই ‘আনপ্লেয়েবল’ না হলে ছেড়ে দেন না, ডিফেন্স ও করেননা। গ্যাপ খুঁজে সেই বল থেকে সিংগেল নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবার তিনি কিন্তু নেমেই শটের ফুলঝুরি হাঁকিয়ে রানকে মোটাসোটা করতে চান না।
তিনি সময় নেন, তবে সেই সময়ে বল খরচ করেন না। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানেরা যেভাবে নেমেই প্রতিটি বল থেকে অন্তত সিংগেল নেওয়ার চেষ্টা করেন, রোহিত শর্মা একজন ওপেনার হয়েও সেটি করেন। আর এরপর উইকেটে যখন তিনি টিকে যান, ক্রিকেট ব্যাকরণের সব কয়টি সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক শট খেলে চলেন। এই যে শুরুর দিকে ডট না দেওয়া আর সেট হয়ে উইকেটের চারপাশে শট খেলা- এটিই রোহিত শর্মাকে ওয়ানডে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বানিয়ে দিচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ তে ফেরা যাক। শ্রীলঙ্কার সাথে যে ম্যাচটিতে রোহিত শর্মা ডাবল সেঞ্চুরি(২০৮) করেন, সে ম্যাচে প্রথম ১০০ রান আসে ১১৫ বলে, যেখানে পরের ১০০ তে রোহিত বল খরচ করেছেন মাত্র ৩৮ টি – ভাবা যায়!
অনেকেই হয়তো স্বীকার করবেন না,আমার কথা মেনেও নেবেন না, রোহিত শর্মাকে ইনিংসের শুরুতে কিন্তু বেশ নড়বড়ে মনে হয়। ইনিংসের শুরুতেই অফ সাইডের বলে ব্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাস রোহিত শর্মাকে ভুগিয়েছে অনেকবার, স্লিপ কর্ডনে ক্যাচ দিয়ে তিনি ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে।
কিন্তু শুরুর এই সময়টা কাটিয়ে উঠলে, ম্যাচের সময় গড়ালে রোহিত শর্মার খেলার চিত্রটাও পাল্টাতে থাকে। অজানা কোন উপায়ে আত্মবিশ্বাস ভরত করতে থাকে রোহিতের ওপর, বলের সাথে রোহিতের ব্যাটকে মনে হয় অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ।
তবে এই চিত্র আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। রোহিত শর্মা আজকাল ইনিংসের শুরুতে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে সাবধানী থাকার চেষ্টা করছেন, প্রতিটি ম্যাচেই যত রানই তিনি করুন না কেন, শুরুটা করেন একেবারে নিখাদ! পরিসংখ্যান আর ফলাফলে রোহিত তাতে আরো এগিয়ে যাচ্ছেন কোন সন্দেহ নেই!
রোহিত শর্মা এখনই ওয়ানডে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তবে যে ধারাবাহিকতায় তিনি এগিয়ে চলেছেন, এটা খুব সম্ভবত কোন রাখঢাক ছাড়াই বলা যায়, ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরার মুকুটটা পরতে হয়তো ক্যারিয়ার শেষে একদমই সময় নেবেন না রোহিত!