এখনকার প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি হয়ত অপরিচিত। কারোর কাছে আবার তাঁর নামটিই অশ্রুতপূর্ব। তার আগের প্রজন্মের কাছে তিনি নেহাতই ধূসর এক উপস্থিতি। আরও পিছিয়ে গেলে বিস্মৃতপ্রায় এক অস্পষ্ট আভাস ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু নন। আসলে মহীরুহের অস্তিত্ব যে তার উত্তরাধিকারে, এবং বংশগত পেডিগ্রি সেখানে অনাবশ্যক, যদিও ব্যতিক্রম রয়েছে।
পঙ্কজ রায়কে চাক্ষুষ দেখার বা তাঁর ঋজু কন্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য এই অধমের হয়েছে। যদিও ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়া একটি স্কুলছাত্রের পক্ষে তখন বোঝা সম্ভবই ছিল না যে কতবড় ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হল সে। পঙ্কজ সেবার আমন্ত্রিত ছিলেন আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি হিসাবে।
সম্মানজ্ঞাপন ও তাঁর দ্বারা বিজয়ী প্রতিযোগীদের পুরস্কারপ্রদানের ফর্মালিটিগুলো শেষ করার পর প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত ভাষণে খর্বকায়, কিন্তু রীতিমত শক্তপোক্ত চেহারার স্যুট পরিহিত পঙ্কজ হাসিমুখে নিজের ক্রিকেটজীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। আশপাশে হাজির থাকা শিক্ষকরা ও অভিভাবকের দল নীরবে নিশ্চুপে মন্ত্রমুগ্ধের মত তা শুনছিলেন। অত ছোট বয়সে তাঁর সব কটা কথা অবশ্যই বুঝিনি, কিন্তু তাঁর রসবোধ আর সহজ সরল কথাবার্তার রেশ মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেও যেন কানে লেগে থাকছিল।
অনেক পরে জেনেছিলাম ইংল্যান্ডের মাটিতে খেলতে গিয়ে তাঁর ব্যর্থতার কথা..জেনেছিলাম কিভাবে ফ্রেডি ট্রুম্যানের বিষাক্ত পেসের সামনে বারবার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল পঙ্কজের ডিফেন্স!
আর বিস্ময়াহত হয়েছিলাম পঙ্কজ রায়ের খোলা মনের পরিচয় পেয়ে, অত বড় মন না হলে কি নিজের ব্যর্থতাকে না লুকিয়ে বা না এড়িয়ে তা নিয়ে রসিকতা করতে পারেন তাঁর মানের প্রবাদপ্রতীম খেলোয়াড়? তার সঙ্গেই মাথায় রাখতে হবে পঙ্কজের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথাও। পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের সন্তান তিনি, পরবর্তীতে কলকাতার শেরিফও হয়েছিলেন পঙ্কজ।
শুধু কয়েক হাজার রান আর সেঞ্চুরি দিয়ে ব্যাটার পঙ্কজকে মাপা যায় নি, যাবেও না। পঙ্কজ মানে এক প্রতিজ্ঞা। পঙ্কজ মানে এক তপস্যার চূড়ান্ত রূপ। জমিদারবংশের স্বচ্ছল অবস্থার ছেলে তিনি। কিন্তু মাঠে ঘামরক্ত ঝরানো শ্রমিক ব্যাটারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন খেলাটার প্রতি প্রগাঢ় প্রেমে।
ফুটবলেও ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা। বাঙাল বাড়ীর ছেলে হয়েও ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে গোল করে নিজের বাড়ীর কাছেই ভিলেন হয়ে গিয়েছিলেন একদা (তাঁর পরিবার ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ম্যানেজিং কমিটিতে)। পরে বেছে নেন ক্রিকেটকেই।
তাঁর প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে টেকনিক এবং ধারাবাহিকতায় পঙ্কজ বেশ এগিয়ে ছিলেন। প্রথমে মিডল অর্ডারে খেললেও ওপেনার হিসাবে প্রয়োজনীয় অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে তাঁর খুব সময় লাগে নি।
দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড ও নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ছাড়াও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মাটিতে তাদের কিংবদন্তী ফাস্ট বোলারদের ভয়াবহ বাউন্সারবৃষ্টি সামলে করেছিলেন লড়াকু ১৫০। পাকিস্তানে সেঞ্চুরি না পেলেও খারাপ খেলেন নি পঙ্কজ। তৎকালীন ১০ বা তার উপরে টেস্ট খেলা ভারতীয় ওপেনারদের মধ্যে বিজয় মার্চেন্ট ও বুধি কুন্দরনের পরেই ছিলেন পঙ্কজ।
৪৩ টেস্টে ৫টি সেঞ্চুরী ও ৩২.৫৬ গড়ে করেছিলেন ২৪৪২ রান। টেস্ট বাদে অন্যান্য প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটেও তাঁর ছিল ২৭টি শতরান সমেত সাড়ে পাঁচ হাজারের উপর রান। তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট ও ফুটবলের দন্ডমুন্ডের কর্তা তথা প্রধান নির্বাচক মণীন্দ্র দত্তরায় বা বেচুবাবুর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ও পঙ্কজকে প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক শোনা গিয়েছিল।
কিন্তু নিন্দুকে যাই বলুক, নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভিনু মানকড়ের সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুড়িতে বিশ্বরেকর্ডের সময় তৎকালীন ভারত অধিনায়ক পলি উমড়িগড়ের বিরুদ্ধে পঙ্কজকে ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তিকর চিরকুট পাঠিয়ে আউট হতে বাধ্য করার অভিযোগই হোক, কি ফিল্ডিং প্র্যাকটিসে ম্যানেজার হেমু অধিকারীর পঙ্কজের আঙুল লক্ষ্য করে বল ছুঁড়ে তাঁকে আঘাত করার চেষ্টার কথা হোক..মণীন্দ্রবাবুর থেকে পঙ্কজ কোন সমর্থনই পান নি ক্রাইসিস পিরিয়ডগুলোতে।
বরং প্রথম বাঙালি অধিনায়ক হিসাবে লর্ডসে নামার পরের টেস্টেই অধিনায়কত্ব হারাতে হয়েছে। টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার সময় পঙ্কজ ছিলেন তখনকার ভারতীয় ওপেনারদের মধ্যে তৃতীয়। তারপরেও আরও সাত সাতটি বছর দাপটের সঙ্গে ফিট পঙ্কজ খেলে গিয়েছেন রঞ্জি ট্রফিতে..কিন্তু ভারতীয় দলে আর তাঁকে কখনোই ফেরানো হয় নি। যাঁরা মণীন্দ্র দত্তরায়ের তাঁকে সমর্থন করা নিয়ে অনেক কথা বলে পঙ্কজের কৃতিত্বকে নীচু দেখানোর চেষ্টা করেন, তাঁরা কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর দিতে পারেন না।
১৯৬৩ সালের রঞ্জি ট্রফি মরসুমে বাংলা বনাম হায়দ্রাবাদ ম্যাচে রয় গিলক্রিস্টের বিষাক্ত বাম্পার বাউন্সার সামলে ধৈর্য্য ও টেকনিকের সর্বোচ্চ শিল্পকলার উদাহরণ পেশ করা পঙ্কজ রায়ের দুই ইনিংসের সেঞ্চুরী তো ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালীন অমর রূপকথায় স্থান পেয়েছে।
আজীবনের প্রচারবিমুখ, শান্তশিষ্ট ভদ্র মানুষটিকে শেষজীবনে শেরিফ অবস্থাতেও দেখা যেত স্টেট ব্যাঙ্কের টাকা তোলার লাইনে সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গেই নীরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য বলে আত্মপ্রচার করতে তাঁকে কখনও কেউ দেখেনি। তাই ক্যারিবিয়ানে লড়াকু শতরান করে দেশে ফিরেই যথারীতি স্পোর্টিং ইউনিয়নের টেন্টে নেমে পড়তে এতটুকু দ্বিধাবোধ করতেন না।
বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্য ও তাদের ক্রিকেটারদের কাছে সদা সম্মানিত ও নমস্য থাকলেও তাঁর মাপের মানুষ ও ক্রিকেটারের মূল্যায়ন করতে বাঙালী বা বাংলা সর্বদা ব্যর্থ হয়েছিল। তার প্রমাণ নিজের মৃত্যুর পরেও পঙ্কজ দিয়ে গিয়েছেন শ্মশানে শবদেহের দীর্ঘ পংক্তিতে শায়িতাবস্থায়। অনেক পরে সংবাদমাধ্যমের খবরের জেরে ও কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলরের হস্তক্ষেপে পঙ্কজকে দাহ করা হয়।
স্বয়ং সুনীল গাভাস্কার স্বীকার করেছিলেন তাঁর টেকনিকের খুঁতখুঁতানি ও তাকে ভাল থেকে আরও ভাল করার অনুপ্রেরণা তিনি পান পঙ্কজ রায়ের ব্যাটিং দেখে। ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া পঙ্কজের কাছে এটুকুই হয়ত যা স্বান্তনা। নাহলে ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ওপেনারদের তালিকায় থাকার পরেও এতটা অবহেলা কি তাঁর প্রাপ্য ছিল?
ভিনু মানকড়ের সঙ্গে জুটিতে ৪১৩ রানের টেস্ট পার্টনারশীপে বিশ্বরেকর্ডের মালিকানার হাতবদল তো সেই কবেই হয়েই গিয়েছে। এখনকার প্রজন্মের কতজন সেসবের খোঁজ রাখেন তা অজানা।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা ভারতের অন্যতম সেরা টেস্ট ওপেনিং ব্যাটার পঙ্কজলাল রায়কে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় যিনি বাংলা ক্রিকেটের প্রথম বরনীয় ইমারতসদৃশ ব্যক্তিত্ব!