পতনের ডাক বুঝি এভাবেই আসে! কিংবা উত্থান পর্ব যতটা কষ্টসাধ্য, তার চেয়েও বেশি কষ্টসাধ্য বোধহয় পতন ঠেকানো। এই বছর তিনেক আগেই দীর্ঘ ১৬ বছর পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে (ইপিএল) উর্ত্তীর্ণ হয়েছিল লিডস ইউনাইটেড। ইপিএলের প্রত্যাবর্তনে সেবার খুব একটা খারাপও করেনি দলটা।
কিন্তু ৩ মৌসুম বাদেই রেলিগেশনে পড়ে আবারো ইপিএল থেকে অবনমন ঘটলো দলটার। অথচ, ইয়র্কশায়ারের এ ক্লাবটার ইতিহাস বলে, সব মিলিয়ে মোট তিন বার ইংল্যান্ড সেরার মুকুট পরেছে লিডস। অর্থাৎ এক সময়কার ইংল্যান্ডের সেরা দলটা সামনের মৌসুমে ইপিএল খেলার যোগ্যতাই হারিয়েছে। শিরোপা যদি অর্জন হয়, প্রত্যাবর্তন যদি উত্থান হয়, তাহলে এই অবনমনকে পতন না বলে উপায় কই!
অবশ্য এই শতাব্দীতেই লিডস ইউনাইটেড মৃতপ্রায় একটা ক্লাব হয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর কেটে গিয়েছিল ১৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে দেখা যায়নি লিডস ইউনাইটেডকে।
ইপিএলে ফেরার যাত্রায় বারবার কোচ পরিবর্তনও করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তবুও যেন কিছুই হচ্ছিল না। এরপর আগমন ঘটলো এক রাজার। যাকে বলা হয় ‘কোচদের কোচ’। তিনি মার্সেলো বিয়েলসা।
লিডস ইউনাইটেডের ডাগআউটে আসলেন এ আর্জেন্টাইন কোচ। এরপর ঘটলো রূপকথার গল্প। তাঁর ছোঁয়ায় ২০২০-২১ মৌসুমে অবশেষে ইপিএলের টিকিট পায় লিডস ইউনাইটেড। ইপিএলে লিডসের প্রত্যাবর্তনও হলো দুর্দান্ত।
৩৮ ম্যাচে ১৮ টিতে জয় নিয়ে নিজেদের ফেরার মৌসুমেই ৯ম হলো লিডস। যদিও পরের মৌসুমেই আবার মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখে লিডস। কোনোমতে রেলিগেশন বাঁচিয়ে ১৭ নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে দলটা। ক্লাবের এমন ব্যর্থতায় বিয়েলসারও প্রস্থান ঘটে।
কিন্তু ঐ ব্যর্থতা যে আর লিডসের পিছু ছাড়েনি। ২০২১-২২ মৌসুমে কোনোমতে রেলিগেশন পর্ব বাঁচানো এবার আর নিজেদের অবনমন ঠেকাতে পারলো না। ১৯৪৭ সালের পর সর্বনিম্ন ৩১ পয়েন্ট নিয়ে ১৯ নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে এখন ঐতিহাসিক এ ক্লাবটিকে পরের মৌসুমে খেলতে হবে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশীপ।
ইংল্যান্ডের এক সময়কার চ্যাম্পিয়নদের এমন অবনমনের কারণ কি? কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমেই বেরিয়ে আসবে প্লেয়ার্স ট্রান্সফারের ব্যাপারে দলটার উদাসীনতা। মার্সেলো বিয়েলসা কোচ থাকাকালীন বেশ ক’বারই বোর্ডকে নির্দিষ্ট জায়গার জন্য খেলোয়াড় ক্লাবের ভেড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
গত দুই মৌসুম ধরেই লিডসের মধ্যভাগে প্রতিপক্ষের আক্রমণ কিংবা খেলা বিল্ডআপ করার জন্য তেমন কোনো মিডফিল্ডারই নেই। কিন্তু লিডস ইউনাইটেড কখনোই সে সব সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। ফলত, ৩ মৌসুম বাদে সেটার মাশুলই দিতে হচ্ছে ক্লাবকে। এখন ইপিএল খেলার জন্য আবারো ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশীপে খেলতে হবে লিডসকে।
লিডস ইউনাইটেডের আরেকটি ব্যর্থতার নাম কোচ জেসি মার্শের ট্যাকটিকাল মুনশিয়ানা দেখাতে না পারার অদক্ষতা। গত মৌসুমের শেষ দিকে মার্সেলো বিয়েলসার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন এ কোচ। কিন্তু বিয়েলসা যেভাবে লিডসের ফুটবলারদের এক সূত্রে গাঁথতে পেরেছিলেন, তাতে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন জেসি মার্শ।
লিডস ইউনাইটেডের সবশেষ ৯ ম্যাচ একটি বা দুটি ম্যাচে জয় নিশ্চিত হলেও রেলিগেশন পর্ব এড়াতে পারতো তাঁরা। কিন্তু মার্শের অধীনে লিডস শেষ ৯ ম্যাচের একটিতেও জয়ের দেখা পায়নি। শুধু তাই নয়, কাতার বিশ্বকাপের পরে ২৪ ম্যাচে তাঁরা মাত্র ৩ টিতে জয়ের মুখ দেখেছে। স্কোয়াডের দুর্বলতা তো আছেই, তবে কোচ হিসেবে জেসি মার্শ তেমন কিছুই করে দেখাতে পারেননি।
এবারের মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে দারুণ এক মৌসুম কাটিয়েছেন রাফিনহা। এই রাফিনহা আগের মৌসুমেও লিডস ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছিলেন। তাঁর সাথে ফিলিপসও ছিলেন। কিন্তু গত ট্রান্সফার উইন্ডোতেই লিডসের অন্যতম আস্থাভাজন এ দুই ফুটবলার লিডস ছেড়ে আসেন। মূলত, এই দুই ফুটবলারের ট্রান্সফারে এই অল্প সময়ে গুছিয়ে উঠতে পারেনি লিডস। তাই ইপিএল থেকে অবনমনের মতো ঘটনাটা লিডসের ক্ষেত্রে ঘটে এবারই।
দুর্বল স্কোয়াড, কোচ, বোর্ডের উদাসীনতা, মূলত এই তিনের কারণেই লিডস ইউনাইটেড আবারো একটা ব্যর্থ যাত্রার সঙ্গী হতে শুরু করলো। হ্যাঁ। অনেক কোচই, দুর্বল স্কোয়াড নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান। বিয়েলসাই যেমন নড়বড়ে এক স্কোয়াড নিয়ে ইপিএলে তুলেছিল লিডসকে। এরপর লিগের সেরা ১০ এও জায়াগা করে নিয়েছিল। কিন্তু বিয়েলসার পরে এসে জেসি মার্শ সেই মুন্সিয়ানাটা আর দেখাতে পারেননি।
একইভাবে, লিডস ইউনাইটেডেরও দায় কম যায় না। প্রায় ১৬ বছর ইপিএলে নিজেদের পা রাখার মাটি পেয়েছিল লিডস ইউনাইটেড। কিন্তু ইপিএলে ফেরার পর দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনার ছিটেফোঁটাই মেলেনি বোর্ডের কাছ থেকে।
এমনকি রাফিনহা, ফিলিপসদের যোগ্য রিপ্লেসমেন্টও খোঁজার চেষ্টা করেনি দলটা। ফলত, দুর্বল স্কোয়াড নিয়ের এবারের মৌসুম শুরু করেছিল লিডস। আর মৌসুম শেষের সেটারই মাশুল দিতে হচ্ছে তাদেরকে।
শেষবার যখন রেলিগেশনে পড়ে লিডসের ইপিএল থেকে অবনমন নিশ্চিত হয়েছিল, তখন থেকে তাদের ইপিএলে ফিরতে সময় লেগেছিল ১৬ বছর!
এবারও কি সেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষার বেড়াজালে আটকে থাকবে লিডসের ইপিএল প্রত্যাবর্তন? উত্তরটা সময়ই বলে দিবে। তবে উত্থান পতনের এ যাত্রায় লিডস আদৌ সেই আগের লিডস হয়ে ফিরবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা থাকছে প্রবল থেকে প্রবলতর।