নিদাহাস ট্রফি, বিষাদের করুণ উপাখ্যান

আশেপাশে কয়েক হাজার মানুষ। তবুও কেমন এক নিস্তদ্ধতা। একটা উৎকণ্ঠা। কেমন যেন এক গম্ভীর বাতাস বয়ে যাচ্ছে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের উপর দিয়ে। শেষ একটা বল বাকি। জয়-পরাজয়ের ব্যবধান পাঁচ রানের। স্নায়ু-চাপের পারদ তখন আকাশ ছুঁয়েছে। একদিকে, একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতার হাতছানি। অন্যদিকে, অর্জনের তালিকাটা আরেকটু বড় করবার প্রচেষ্টা। একপ্রান্তে অভিজ্ঞতা, অন্যপ্রান্তে বল হাতে অনভিজ্ঞতা। স্নায়ুর খেলায় সেদিন হেরেছিল বাংলাদেশ, জিতেছিল ভারত।

বলছিলাম, ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার ৭০তম বার্ষিকীতে আয়োজিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট নিদাহাস ট্রফির কথা। স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা ছাড়াও সেবার ভারত ও বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল অংশ নিয়েছিল। টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ। ১৮ মার্চের ঘটনা। কি এক অসাধরণ ম্যাচ! সে কি এক স্নায়ুচাপ। অবশ্য বাংলাদেশ সমর্থকরা এতে অভ্যস্ত।

সেই ২০১২ সাল থেকে এশিয়ার কাপের ফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে খেলার ফলাফল পেণ্ডুলামের মত ঘুরতে থাকলেও তা আর কখনোই বাংলাদেশের পক্ষে আসেনি। তবে নিদাহাস ট্রফির সেই ফাইনালে আর একটি সম্ভাবনায় আশার বুক বেঁধেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট ভক্তরা।

কিন্তু ভাগ্য বিধাতা বাংলাদেশের জন্যই বোধকরি সবচেয়ে কঠোর রুপ ধারণ করেন। বারংবার খুব কাছে নিয়ে গিয়েও বঞ্চিত করেন শিরোপা থেকে। স্রেফ তেমন আরেকটি উদাহরণ হয়ে নিদাহাস ট্রফি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে যুক্ত হয়ে রইলো।

১৮ মার্চের সেই সন্ধ্যায় টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাট করতে পাঠায় ভারত। সাব্বির হোসেন সেদিন তাঁর ঝলকটা দেখিয়েছিলেন। সাব্বির ১৫০ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে একহাত দেখে নিয়েছিলেন শার্দুল ঠাকুর, যুজবেন্দ্র চাহাল ও ওয়াসিংটন সুন্দরদেরকে। করেছিলেন ৫০ বলে ৭৭। তাঁর সেই দুর্দান্ত ইনিংসের উপর ভর করেই বাংলাদেশ একটা লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায়। ভারতের অভিজ্ঞ ব্যাটারদের বিপক্ষে যথেষ্ট ভাল করে খেলাটা শেষ ওভার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা।

তবে অধিনায়কের গড়মিল কিংবা মূল বোলার মেহেদী হাসান মিরাজের এক ওভারে প্রত্যাশার বেশি রান দিয়ে ফেলায় শেষ ওভার করার জন্য বাকি থাকেন কেবল পার্টটাইম বোলার সৌম্য সরকার। শেষ ওভারে প্রয়োজন ১১ রান। সৌম্য়ের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এমন পরিস্থিতিতে বোলিং করার অভিজ্ঞতার ছিল বড্ড অভাব। নিজের স্নায়ুচাপটা তাই আয়ত্তে রাখা বেশ দুর্দমনীয় এক কাজে পরিণত হয় তাঁর জন্য। প্রতিটা ধমনীতে রক্তের প্রবল বেগ স্পষ্ট। শরীরে বারবার বুলানো রুমাল অন্তত তাই বলে।

তা বেশ, সেদিন অবশ্য সৌম্যের কাছে সুযোগ ছিল নায়ক বনে যাওয়ার। সৌম্য খানিক সেদিকে অগ্রসরও হয়েছিলেন। শেষ বলে নিয়ে গিয়েছিলেন খেলা। একটি উইকেট শিকার করে খেলাটাকে আরো বেশি জমজমাট করে ফেলেন তিনি। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার সৌম্যর জন্য সেই শেষ এক বল যেন এভারেস্টে চড়ার থেকেও কঠিনতম এক কাজ ছিল তাঁর জন্য। এর থেকেও বড় বিষয় সেদিন শেষ বল খেলতে ব্যাটিং প্রান্তে ছিলেন অভিজ্ঞতায় ভরপুর দীনেশ কার্তিক।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) কল্যাণে এমন বহু পরিস্থিতি সামলেছেন কার্তিক। তাঁকে হয়ত সেই স্নায়ুচাপ ছুঁয়ে যেতে পারেনি। তিনি একেবারে ছিলেন শান্ত। তবে মেরুর অপরদিকে থাকা সৌম্য হাতের বলটা ততক্ষণে কয়েকশো কেজি ওজন হয়ে গেছে। তবুও তিনি ছুটে গিয়ে বল করলেন। অফ সাইডের বেশ বাইরে তিনি বল করলেন। সম্ভবত ওয়াইড ইয়োর্কার করতে চেয়েছিলেন। তবে সমীকরণ মিলল না। ইয়োর্কার আর গতির সংমিশ্রণটা ঠিকঠাক হয়নি। সজোরে সেই শট চালালেন কার্তিক।

সৌম্য সে বলটা করার আগে হয়ত ভেবেছিলেন বড়জোড় একটা চার হবে। খেলাটা যাবে সুপার ওভারে। কিন্তু না কার্তিক তাঁর অভিজ্ঞতা এবং পেশি শক্তি পুরোটাই ঢেলে দিলেন তাঁর ব্যাটে। ব্যাস! তাতেই বল উড়ে গিয়ে পড়লো সীমানার বাইরে। আরও একবার হাতছাড়া স্বপ্ন। আরও একবার অশ্রুসিক্ত নয়ন। একদিকে উল্লাস। আরেকদিকে একরাশ বিষাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link