এ যেন এক বিস্ময়! পুরো পৃথিবী স্তব্ধ করে দেওয়ার মত এক বিস্ময়। একজন মানুষ তিনি ঘন্টায় ১৬১.৩ কিলোমিটার গতিতে একটি বল ছুঁড়েছেন। এ ও কি সম্ভব! হ্যাঁ সম্ভব বলেই সেটা এখন রেকর্ড বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে সবার উপরে। আর এই রেকর্ডের পাশে লেখা রয়েছে শোয়েব আখতারের নাম।
পাকিস্তানের পেস ভাণ্ডার থেকে উঠে আসা আরেক কিংবদন্তি, আরেক তারকা শোয়েব আখতার যেন ছিলেন গতির অপর নাম। তাঁর সেই গতির জন্য ডাকনাম হয়ে যায় ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’। রাওয়ালপিন্ডি থেকে উঠে আসা শোয়েব পুরো বিশ্বক্রিকেটকে দেখিয়েছেন যে কি করে বাইশ গজে ঝড় তুলতে হয়। কি করে ছুঁড়তে হয় এক এক অগ্নিগোলক।
তিনি যেন নিয়ম করে গতির ঝড় তুলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাঁর পুরো শরীর যেন ছিল একটি মেশিন। অদ্ভুত এক ইঞ্জিন দিয়ে গড়া তাঁর শরীর। চাইলেই যেন তিনি পারেন প্রতিপক্ষে ব্যাট-প্যাড ছিড়ে স্ট্যাম্প পর্যন্ত উপরে ফেলতে। তিনি সেটা করেও দেখিয়েছেন। শুধুমাত্র গতি দিয়ে নয়, তিনি বাউন্স দিয়েও কুপোকাত করতে পারদর্শী ছিলেন।
তাছাড়া বল করার আগেই ব্যাটারদের চিন্তা নিয়েও খেলা করতে জানতেন তিনি। তা নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ প্রসিদ্ধ। তিনি রীতিমত প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের জন্য ছিলেন আতঙ্ক। আর তরুণ পেসারদের আদর্শ। তাঁকে দেখে পেস বল হাতে গতির ঝড় তুলতে চাওয়া কিশোরদের তালিকাটা নিশ্চয়ই বড্ড বেশি লম্বা। সেখানটায় অনেকের বসবাস।
আদর্শ হবেনই বা না কেন? ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের মঞ্চ। সেবারের আসর বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। এটা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট খানিকটা পেস সহায়ক। পেসাররা উইকেটগুলো থেকে একটা বাড়তি সুবিধা পান। তবে সে বাড়তি সুবিধায় নিশ্চয়ই গতিটা থাকে না। সেটা বোলারকে উৎপন্ন করতে হয়। সে কাজটাই করেছিলেন শোয়েব আখতার।
গ্রুপ স্টেজের ম্যাচ। তাও আবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। কেপ টাউনের সে ম্যাচে শোয়েব আখতারের করা একটি বল ছুঁয়ে ফেলে ১০০ মাইল/ঘন্টার রেকর্ড। আর সেদিন থেকে আজ প্রায় দুই দশক ধরে রেকর্ডটা রয়ে গেছে তাঁর দখলে। বলের গতিতে তাঁকে আজ অবধি ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কেউ। সম্প্রতি নিজের করা সেই বলের পেছনের রহস্য নিয়ে প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন সাবেক এই গতি তারকা।
তিনি বলেন, ‘যখন আপনি একজন বোলার হিসেবে নিয়মিত ১৫৫-৫৬ কিলো/ঘন্টা গতিতে বল করবেন তখন আপনার মনে রাখতে হবে আরও পাঁচ কিলো/ঘন্টা গতির উৎপন্ন করার ক্ষমতা আপনার মধ্যে রয়েছে। তবে সে অতিরিক্ত গতিটুকু ঢেলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বিশেষ ট্রেনিংয়ের। ১০০ মাইলে বল করার আগে আমি নিয়মিত ১৫৬-৫৭ কিলো/ঘন্টা গতিতে বল করতে পারতাম। তবে কিছুতেই আমি ১৬০ ছুঁতে পারছিলাম না। সে সময় বেশ চিন্তিত ছিলাম যে কেন আমি পারছিলাম।’
তিনি যেন ১০০ মাইলের সে মাইলফলকটা ছুঁয়ে দেখতে পারেন সে জন্য সে ভিন্নধর্মী অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন। কোমরে টায়ার বেঁধে তিনি দৌড়াতে লাগলেন। তবে তাও ঠিক সুবিধার ঠেকছিল না তাঁর কাছে। এ নিয়ে শোয়েব বলেন, ‘আমি প্রথমে কোমরে টায়ার বেঁধে দৌড়াতে লাগলাম। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমার তা হালকা মনে হতে লাগল। আমি এরপর কাঁধের সাথে ছোট ছোট গাড়ি বেঁধে টানতে লাগলাম। রাতের বেলা ইসলামাবাদে মানুষে আনাগোনা কম থাকে তাই আমি রাতের বেলা সে অনুশীলন করতাম। আর আমি চেষ্টা করাতাম আমার রান আপের গতির সাথে মিল রেখে দৌড়াতে।’
না সেখানেই ক্ষান্ত হয়ে যাননি শোয়েব আখতার। গতির নেশায় মত্ত শোয়েব নতুন এক পন্থা খুঁজে বের করেন। নতুন পন্থা নিয়ে শোয়েব বলেন, ‘তবে ছোট গাড়ি টানাটাও আমার কাছে খুব সহজ কাজ মনে হতে থাকে। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ট্রাক টেনে নিয়ে যাব। আর আমি প্রায় আট কিলোমিটার ট্রাক টেনে নিয়ে যেতাম।’
অনেকের কাছেই শোয়েব আখতারের এমন কর্মকান্ড বদ্ধ উন্মাদের কান্ড বলে মনে হতেই পারে। হ্যাঁ, শোয়ব উন্মাদ। তিনি উন্মাদ নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উন্মাদনায়। তিনি উন্মাদ ক্রিকেটের ভালবাসায়। এমন উন্মাদদের জন্যই হয়ত ক্রিকেট নামক খেলাটা ক্রমশ জনপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়ে দেখছে।