উত্থান, পতন, মৃত্যু ও শেষকৃত্য

ইতিহাস বলে, স্বাগতিক হিসেবে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ সুবিধাটা কেনিয়াই নিতে পেরেছিল। সেটা ২০০৩ সালের কথা। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক ছিল কেনিয়া। ঘরের মাঠের সৌভাগ্য আর কার্যকর কিছু পারফরম্যান্সের সুবাদে দলটা চলে গিয়েছিল সেমিফাইনালে। শেষ চারের ম্যাচে স্রেফ ভাগ্যের দোষ আর অভিজ্ঞতার অভাবে পারেননি।

সেটা হতে পারতো, কেনিয়ার ক্রিকেটের টার্নিং পয়েন্ট। হয়নি, বরং কালক্রমে দেশটির ক্রিকেট চূড়ান্ত পতনের মুখ দেখেছে।

কেনিয়ার ক্রিকেটে উত্থান অবশ্য হয়েছিল আরো আগে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে তাঁদের সামনে মাত্র ৯৩ রানে অলআউট হয়ে যায় প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। প্রথম বিশ্বকাপে নেমেই সাবেক চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয় অধিনায়ক মরিস ওদুম্বের দল। তখন এই মরিস ওদুম্বে, আসিফ করিম, মার্টিন সুজি কিংবা স্টিভ টিকোলোরা বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন।

তখন নিয়মিত খেলার সুযোগ পাচ্ছিল কেনিয়া। নানা রকম ত্রিদেশীয় কিংবা চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টে তাদের দেখা ছিল। বাংলাদেশের পর তারাই ক্রিকেট বিশ্বের ১১ তম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হতে যাচ্ছে – এমনটা ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’।

২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর।

এরপর ২০০৩ সালে আসে সেই অবিস্মরণীয় সাফল্য। সেটা টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য তো বটেই, যথেষ্ট হল না ক্রিকেটে কেনিয়ার টিকে থাকার জন্য। কারণটা পরিস্কার, অবকাঠামো আর জনপ্রিয়তার অভাব। ইংল্যান্ডের যেকোনো পাবলিক স্কুলের মাঠে যতগুলো নেট আছে, গোটা কেনিয়াতেও ততগুলো নেই। তার ওপর, দেশটির ক্রিকেট কেবল কয়েকটা পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

সেই একই কথা আজকের দিনে এসেও সত্য। কেনিয়ার ক্রিকেটটা কখনোই সর্বসাধারণের জনপ্রিয়তা আদায় করে নিতে পারেনি, ঘরে ঘরে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়া তো বহু দূরের কথা।২০০৩ বিশ্বকাপে দলটা যে জাদু দেখিয়েছিল তার ছিঁটেফোটাও ছিল না ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপে। আট ম্যাচের মধ্যে জিততে পেরেছিল মাত্র একটিতে। এর ওপর ২০১১ সালের পর থেকে তাদের আর বিশ্বকাপেই দেখা যায়নি। মাঠের পারফরম্যান্সের সাথে সাথে ক্রিকেটের রাজনীতি ও অর্থনীতিও করুণ আকার ধারণ করে।

এর সবচেয়ে কুৎসিত রূপটা দেখা যায় ২০১৪ সালে এসে। আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ারের সুপার সিক্স রাউন্ডটা কেনিয়া শেষ করে সবার শেষ দল হিসেবে। আইসিসি কেড়ে নেয় ওয়ানডে স্ট্যাটাস। অপমানের চূড়ান্ত হয় যখন দলটা আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম হয়ে নেমে যায় আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের দুই নম্বর ডিভিশনে।

দ্বিতীয় ডিভিশনে গিয়ে নিজেদের ছয়টা ম্যাচের সবগুলোতে হেরে দলটা নেমে যায় তিন নম্বর ডিভিশনে। অধিনায়ক রাকিব প্যাটেল ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে দাঁড়ান। সরে দাঁড়ান সাবেক ক্রিকেটার থেকে কোচ বনে যাওয়া থমাস ওদয়ো ও বোর্ড সভাপতি জ্যাকি জান মোহাম্মাদ।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে ক্যারিবিয়ানদের মঞ্চে কুপোকাত করার সেই ম্যাচ।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এই ওদয়ো হলেন কেনিয়ার স্বর্ণযুগের তারকাদের একজন। ২০০৩ সালের সেমিফাইনাল খেলা দলেরও একজন ছিলেন।

কয়েক মাস পর শেম এনগোচেকে দলের অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। সাবেক অধিনায়ক ও ফিক্সিংয়ের দায়ে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞ কাটিয়ে ফেরা মরিস ওদুম্বেকে কোচ করা হয়। এই জুটির অধীনে কিছুটা বিপদ কাটিয়ে তোলে আফ্রিকান দেশটি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আফ্রিকান অঞ্চলের ফাইনালের জন্য কোয়ালিফাই করেন। আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আরো সুযোগ পেয়েছে নামিবিয়া।

এই দু’টি দল এখন আরো ১২ টি দলের সাথে লড়বে ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই বাছাইপর্ব চলতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। এখান থেকে ছয়টি দল যাবে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাথে খেলবে আরেকটি প্রাক টুর্নামেন্ট বাছাইপর্ব। এই আট দল থেকে চারটি দল খেলবে বিশ্বকাপের মূল পর্বে।

বোঝাই যাচ্ছে, কেনিয়ার এই বিশ্বকাপে যাওয়ার রাস্তাটাও খুব কঠিন। শেম এনগোচে এখনও দলের অধিনায়ক। কোচ এখন ডেভিড ওবুইয়া। তিনিও সেই বিখ্যাত ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে ছিলেন। মজার ব্যাপার হল তার এক বছরের আপন ছোট ভাই কলিন্স ওবুইয়া এখনো জাতীয় দলে খেলেন। দলে আছেন আসিফ করিমের ছেলে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ইরফান করিমও।

মানে আজো দেশটির ক্রিকেট কয়েকটা পরিবারের মধ্যেই আটকে আছে। কেনিয়ার ক্রিকেটও এখন আর কিছু সুখস্মৃতি রোমন্থনের বেশি কিছু ভাবতে পারে না!

২০০৩ সালের বিশ্বকাপ খেলা অধিনায়ক আসিফ করিম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘কেনিয়ার ক্রিকেট মরে গেছে।’ মরিস ওদুম্বে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘কেনিয়ার ক্রিকেট মরে গেছে, শেষকৃত্যও শেষ।’ অপেক্ষা কেবল দাফনের। এর আগেই কি ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হতে পারবে দলটি?

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link