তামিম ইকবাল ধাঁধা

তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে রান সংগ্রহের দিক থেকে সফলতম ব্যাটসম্যান। টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেট মিলে ২২ টা সেঞ্চুরি আর ১১,০০০ এর উপরে রান করা চাট্টিখানি কথা না, বাংলাদেশি কোন খেলোয়াড়ের জন্য তো নাই ই! আজ থেকে ১০ বছর আগে কেউ যদি আমাকে বলত যে বাংলাদেশি কোন খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৩,০০০ রান করে ফেলব এটা আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করতাম না।

১৯৭৫ এর পরে জন্মেছে এমন কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে – আমি ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট’ এই কিওয়ার্ড টা বলব – আপনি ৫ সেকেন্ডে ৫ টা নাম বলবেন, মানে চিন্তা করার সময় না দিয়েই ৫ টা নাম বলতে হবে তাহলে, আমি নিশ্চিত যে ৭৫ শতাংশের বেশি লোক ৫ টা নামের ভেতরে তামিম কে রাখবে।

শুধু ক্রিকেটার হিসেবে না, ব্যক্তি তামিমও ক্যারিশম্যাটিক। সে স্মার্ট, ইংরেজি ভাল বলতে পারে, ক্রিকেটীও পরিবার থেকে এসেছে। করোনার সময়ে খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে তামিম ইউটিউবে যে সমস্ত অনুষ্ঠান বানিয়েছে, বাংলাদেশের কোন ক্রিকেট সাংবাদিক তার ধারে কাছে কোনও ভিডিও কন্টেন্ট বানাতে পারেনি, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে সেগুলো দেখেছি, তামিমের স্বত:স্ফুর্ত উপস্থাপনা এবং বিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি।

তামিম আমার যৌবন রাঙিয়ে দেওয়া খেলোয়াড়। তামিমের কথা মনে হলেই মাথায় ভাসে ভারতের সাথে ২০০৭ এর সেই বিশ্বকাপের ম্যাচে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে ছক্কা মারা, লর্ডসের মাটিতে ইংল্যান্ডের সাথে সেঞ্চুরি করে পিঠে আঁকিবুঁকি একে অনার্স বোর্ডে নাম লেখানোর সংকেত দেওয়া, বা এশিয়া কাপে টানা হাফ সেঞ্চুরি করে আঙ্গুলে সেগুলো গুনে দেখানো। সবগুলোতেই যৌবনের ঔদ্ধ্বত্য প্রকাশ পায়।

সময়ের সাথে সাথে আমার মত সেই ২০০৭ এর তামিমেরও বয়স বাড়ল। যে শুধু কোন দিকে না তাকিয়ে ডাউন দি উইকেট এ গিয়ে স্লগ করত সে আস্তে আস্তে পরিণত হল, আমাদের ক্রিকেটকেও দু’হাত ভরে দিল। এর ফাঁকে ক্রিকেটটাও অনেক বদলে গেল। টি-টোয়েন্টি নামে এক নতুন সংস্করণ এসে হানা দিল পৃথিবীর বুকে। ওয়ানডেটাও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল।

যেই ২০০৭ সালে তামিম – ভারতের সাথে জয় এনে দিল, সেই ভারতীয় দলের কেউ ই এখন আর খেলে না – কী বিশাল বিশাল সব নাম ছিল – সৌরভ, শচীন, শেবাগ, দ্রাবিড়, যুবরাজ! কেউই আর নেই, এমনকি ধোনিও না।

বেশি রান করাটাই আর মুখ্য ব্যাপার হয়ে থাকলো না, কত দ্রুত রান করা যায় সেটাই হয়ে উঠল মুখ্য – শচীনের ১০০ তম ১০০ তে অভিনন্দনের বদলে নিন্দার ফিসফাসও বাতাসে ভাসতে লাগল আস্তে রান করার জন্য।

ক্রিকেটে এল জস বাটলার, ডেভিড ওয়ার্নার, কুইন্টন ডি কক, অ্যারন ফিঞ্চ, রোহিত শর্মা, মার্টিন গুপ্তিল এর মত ওপেনাররা। ৫০ ওভার ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরিও হয়ে গেল বেশ কয়েকটা। আগে ২৭৫ করলেই জেতা যেত, এখন ৩৫০ রানও আর নিরাপদ টার্গেট থাকল না। ওয়ানডেতে প্রথম ১৫ ওভার বা টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ৬ ওভারের ভেতরেই খেলার মোমেন্টাম সেট হতে থাকল, তার উপর ভিত্তি করে শেষের দিকের ধ্বংসযজ্ঞ।

এদিকে, তামিমের ব্যাটে কিন্তু রান কমল না, বাড়তেই থাকল, কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার স্ট্রাইক রেট বাড়ল না। ওয়ানডে তে ৭০ থেকে ৮০ আর টি-টোয়েন্টি তে ১১০ থেকে ১১৫ এর আশে পাশে ঘুরতে লাগল সেটা।

প্রথম প্রথম সেটা কোন সমস্যাই ছিল না, কারণ আমরা জেতার কথা খুব কমই ভাবতাম। সমস্যা তৈরি হল যখন আমরা জেতা শুরু করলাম, তখন থেকে মনে হওয়া শুরু হল যে আসলেই কি এখন একজন ওপেনার যদি ওয়ানডেতে ৩০০ বলের ভেতরে প্রথম ১০০ বল খেলে ৭০ বা টি-টোয়েন্টি তে ১২০ বলের ভেতরে ৪৫ বল খেলে ৫০ করে তাহলে কি আমরা অন্যদের সাথে পাল্লা দিতে পারব?

এখানেও আমরা সান্ত্বনা খুঁজে নিলাম। তামিম একটা অন্য ধরণের রোল প্লে করে, সে একদিকে ধরে রাখে, যেন উইকেট না পড়ে। সেটাও মাথায় ঢুকল, কারণ একটা সময় ছিল যে বাংলাদেশ ব্যাটিং এ নামলেই ২০ রানের ভেতরে ৬ টা উইকেট হাওয়া – হান্নান সরকার, জাভেদ ওমর, আল শাহরিয়ার, সানওয়ার হোসেন সবাই ফিরে গিয়েছেন প্যাভিলিয়নে – এরপর খালেদ মাসুদ আর মোহাম্মাদ রফিকের ৫০ ওভার টিকে থাকার সংগ্রাম। ঠিক এমন না হলেও, এই ধরণের চিত্র ছিল নিত্তনৈইমত্তিক। ঐ খেলোয়াড়দের নাম অন্য নাম দিয়েও বদলে দিতে পারেন, ফলাফল একই।

কিন্তু আস্তে আস্তে তামিমের এই বিশেষ ধরণের রোলের পেছনে গ্রহণযোগ্যতাও আস্তে আস্তে কমতে লাগল – বাংলাদেশের দলটাতেও তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে – এখন তো আর ২০ রানে ৫ উইকেট পড়ে যায় না প্রতি ম্যাচে। অনেকদিন ধরে উসখুস করতে থাকা এই জিনিসটা বিশ্বকাপে এসে বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। টার্গেট যাই হোক না কেন, তামিমের পাওয়ার প্লেতে স্ট্রাইক রেট বাড়াতে না পারাটা, অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানদের উপর চাপটা বাড়িয়েই দিতে লাগল।

যাই হোক – বিশ্বকাপ শেষ হল। আমরা ভাবতে লাগলাম স্ট্রাইক রেট যাই হোক না কেন, তামিম ছাড়া কি কখনো জেতা যায় নাকি, চোখে তো সেই ২০০৭ এর ছক্কা এখনও ভাসছে! তামিম ছাড়াই আমরা টি-টোয়েন্টি খেলতে ভারতে গেলাম। সেখানে একটা ম্যাচ জিতেও ফেললাম, ভারতের সাথে, ভারতের মাটিতে, টি-টোয়েন্টিতে! আর তামিমের বদলে খেলতে নামা নাঈম শেখ নামের এক খেলোয়াড় আরেকটা ম্যাচ প্রায় জিতিয়েই ফেলল।

আর তার বেশ আগে থেকেই লিটন দাস নামে এক খেলোয়াড় ১৩৫ স্ট্রাইক রেটে টি-টোয়েন্টি, আর ৯৫ স্ট্রাইক রেটে ওয়ানডে খেলা শুরু করল বাংলাদেশের হয়ে। সাথে সাথে সৌম্যও ওয়ানডে তে ১০০ আর টি-টোয়েন্টিতে ১২৫ স্ট্রাইক রেটে খেলতে থাকল।

এত কিছুর পরও – সবার মনে একটা আশঙ্কা আর হাহুতাশ থেকেই গেল – ‘বিকল্প কই?’। ‘খেলবে কে? আপনি খেলবেন?’। আমিও ছোটবেলায় এরকম ভাবতাম ভারতের ক্রিকেট দলটাকে নিয়ে। আমার মনে হত যে – শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড় গেলে ভারতে খেলবে কে?

এই খেলবে কে এই ধাঁধাঁ তেও আবার চিড় ধরল – টিভিতে দেখানো দুইটা জমজমাট টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। ডিসেম্বর – জানুয়ারিতে হওয়া বিপিএল এ টি-টোয়েন্টি তে আফিফ – লিটন একই দলে ওপেন করল – আফিফ রান করল ১৩৬ স্ট্রাইক রেটে, লিটন ১৪০ স্ট্রাইক রেটে , সৌম্য একটু নিচে নেমে ১৪৮ স্ট্রাইক রেটে। সেখানে তামিম যথারীতি ১১৫ – তার স্টান্ডার্ড ধরে রেখে।

এরপর প্রেসিডেন্টস কাপ এর পর হল বঙ্গবন্ধু কাপ। অনেকগুলো খেলা হল – এক একজন ৮/৯ টা খেলা খেলে ফেলল। ওপেনিং এ শান্ত এসে ১৫৫ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে টুর্নামেন্ট খেলল, লিটন ১২৫ এ, সৌম্য ১২৭ এ, নাইম ১৩৪ এ, আর আফিফ একটু নিচে নেমে ১৪৬ এ। একটা জিনিস কিন্তু অপরিবর্তিত থাকল, সূর্য ওঠার মত। ওপেন করে তামিমের স্ট্রাইক রেট – ঠিক সেই বিপিএলের মতই রয়ে গেল – অথবা বলতে পারি, পুরো টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের মতই। কত বলুনতো? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন – ১১৫!

মাঝখানে আবার একটা দারুণ ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশের যুবারা অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। আমাদের এ পর্যন্ত জাতীয় দলে খেলা অনেক খেলোয়াড়ই অনূর্ধ্ব ১৯ দল থেকে আসা। সেই খেলোয়াড়রা সবাই বড় বড় তারকা ছিল, রোকন, আশরাফুল, আফতাব, মুশফিক, তামিম, সাকিব – কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য প্লেট চ্যাম্পিয়ন হওয়া – মানে বাদ পড়ে যাওয়া দলগুলোর মাঝে চ্যাম্পিয়ন। সেখানে পুরো টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়াটার মানে দলে এমন কিছু খেলোয়াড় আছে যারা হার না মানা – রিয়াল চ্যাম্প! যাদের ভেতরে ২০ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। তাদের খেলাটাও দেখে ফেললাম – ইমন, জয়, তৌহিদ হৃদয়, আকবর, শামিম। হার না মানা চেহারাও দেখলাম। আগের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের খেলোয়াড়দের টেকনিকে যে সমস্যা ছিল, এই গ্রুপের ভেতর সেটা বড় দাগে দেখলাম না। আমার বিশ্বাস, জাতীয় দলের সাথে এই দলের কয়েকটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হলেই এটা বোঝা যাবে।

তামিম ইকবাল কোনানন্ড্রাম টা আরও শক্ত হল আমার ভেতরে।

তামিমের কি শুধু টেস্টই খেলা উচিৎ, যেখানে তার ধারে কাছে কেউ নেই? টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে তে না খেললে কি তামিমের গ্রেটনেস বিন্দুমাত্র কমবে? রাহুল দ্রাবিড়ের থেকে ভাল খেলোয়াড় ক্রিকেটের ইতিহাসে খুব বেশি আছে কি? তিনিও তো কোনদিন টি-টোয়েন্টি খেলেননি তার দেশের হয়ে। তার গ্রেটনেস কি কমেছে তাতে?

নাকি, টি-টোয়েন্টিতে ১১০-১১৫ এর আশে পাশে স্ট্রাইক রেট নিয়ে যে তামিম সবসময় খেলছে তাকেই খেলিয়ে যাওয়া উচিৎ? সাথে ৭০-৮০ স্ট্রাইক রেট নিয়ে ওয়ানডেও?

সেটাই যদি হয় তাহলে ওপেনিংয়ে তামিমের বদলে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে খেলতে হলে নাইম, লিটন, আফিফ, সৌম্য, শান্ত কে কি করতে হবে? তারা কি টানা ২০ টা ম্যাচ পাবে না কখনই?

আরেকটা প্রশ্ন যে, যদি তামিমকে খেলানো হয় – তাহলে সেটা কতদিন? পরবর্তি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও? পরবর্তি ওয়ানডে বিশ্বকাপেও? তারপরেও? টি-টোয়েন্টি অথবা ওয়ানডেতে তামিমকে দেখতে গিয়ে কি টেস্ট এর দুর্দান্ত তামিমকেও খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে কোন?

এখানে অবশ্য সাংবাদিক, স্পন্সরদের একটা বড় ভূমিকা আছে – তামিম একজন বড় ব্র্যান্ড – আমি এখন পর্যন্ত কোন সাংবাদিককে বলতে শুনিনি যে তামিম টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডেতে স্লো খেলছে – বরং লেখা দেখেছি – তামিমের সাথে কে? এটা কি ভয় থেকে? একজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পারসনের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার ভয়? ব্রান্ড নেম থেকে দূরে চলে যাওয়ার ভয়? তামিমের একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টার্ভিউ নিতে না পারার ভয়? ফ্যানদের কাছ থেকে অজনপ্রিয় হওয়ার ভয়?

আমার মাথায় শুধু এই প্রশ্ন গুলো ঘুরছে। সাথে আরও কিছু প্রশ্ন।

আপনাদের মাথায় কি এগুলো এসেছে কখনো?

  • এই তামিম ইকবাল কোনানন্ড্রাম কি পরবর্তী বিশ্বকাপগুলোতে (ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি) আমাদের ভোগাতে পারে?
  • তামিমকে নিয়েই কি আমাদের নিকট ভবিষ্যতের ওয়ানডে দল বেশি ভাল হবে?
  • তামিমকে নিয়েই কি আমাদের নিকট ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টি দল বেশি ভাল হবে?
  • তামিমকে ছাড়াই কি আমাদের নিকট ভবিষ্যতের ওয়ানডে দল বেশি ভাল হবে?
  • তামিমকে ছাড়াই কি আমাদের নিকট ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টি দল বেশি ভাল হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link