ক্রিকেট পিচ বানানো কি শুধুই পুরুষের কাজ? না, ইতিহাসের পাতায় এমন একটা মাঠ আছে, যেখানে নারীরা মাটি ঘেঁটে গড়েছেন উইকেট, আর তাতে খেলেছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান থেকে সুনীল গাভাস্কার, স্যার গ্যারি সোবার্স থেকে লঙ্কান প্রায় সকল কিংবদন্তি।
এই মাঠ, এই মাটি, এই গল্প — ম্যারিয়াম্মার। পুরো নাম আরুল ম্যারি। কলম্বোর পি সারা ওভালের ইতিহাসে তিনি ‘ম্যারিয়াম্মা’ নামেই বেশি পরিচিত। বিশ্বের একমাত্র নারী পিচ কিউরেটর তিনি। একমাত্র না হলেও প্রথম তো বটেই, তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীতে অনেক নারী কাজ করে গেছেন পি সারা ওভালের মাঠে।
জীবনের টানা ৪০ বছর তিনি কলম্বো ওভালকে দেন। বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে পুরুষদের ‘কর্তৃত্বে’ থেকেছে এমন একটা কাজে তিনি বনে যান কিংবদন্তি। ক্ষীণকায় এই তামিল নারী গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে খোদ ব্র্যাডম্যানের নামও।
পি সারা ওভালই আবার এশিয়ার একমাত্র মাঠ যেখানে খেলে গেছেন ব্র্যাডম্যান। তখন ১৯৪৮ সাল। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে ‘ডন’ ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া দল এখনকার শ্রীলঙ্কায় আসে। শ্রীলঙ্কার নাম তখন ছিল সিলন।
পি সারা ওভালের মাঠে সেই ম্যাচটা ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা করে নেয় এক বিতর্ক দিয়ে — পিচটা নাকি ২২ গজ নয়, ২০ গজ! অস্ট্রেলিয়ানরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি। খেলা শুরু হতেই রান উঠছিল না, বল থেমে যাচ্ছিল, স্ট্রোক খেলতে সমস্যা হচ্ছিল। শেষে স্রেফ সন্দেহ থেকে মেপে দেখা গেল — পিচ সত্যিই দুই গজ ছোট!
সেই উইকেটে ব্র্যাডম্যান মাত্র ২০ রান করে ফিরেছিলেন। সেই উইকেটে তৈরি করেছিলেন আরুল ম্যারি। তবে, ছোট উইকেট বানানোর দায় তার নয়।

ফিঙ্গলটন নামক এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক তখন লিখেছিলেন, ‘সম্ভবত তাঁর কোনো পুরুষ সহকারী ভুল মাপ করেছিলেন। তবে যে নারীর ছোঁয়ায় উইকেট তৈরি হয়েছিল, সেটা কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল।’
আরুল ম্যারি ছিলেন ভিন্ন এক ধারার বাহক। তাঁর বোন অমরাবতী, এরপর সরোজা ভেল্লাই—তাঁরা সবাই ছিলেন এই মাঠের নীরব কারিগর। পি সারা ওভালে নারীরা লম্বা সময় সার্ভিস দিয়েছেন। এমনকি ২০০০ সালের পরও তাঁদের অনেকেই মাঠের কাজ করতেন।
তাঁদের বাস ওয়ানাথামুল্লায়। কলম্বোর এক তামিল পাড়া। সেখানেই একটা ডোবা মাটি ভরাট করে চল্লিশের দশকে বানানো হয় কলম্বো ওভাল গ্রাউন্ড, যার নাম কালক্রমে হয় পি সারা ওভাল। এই এলাকায় পুরুষেরা চা-বাগানে কাজ করেন, আর নারীরা মাঠে।
দিনশেষে ঘরে ফেরার আগে কেউ কেউ পিচে পানি দেন, কেউ ঘাস ছাঁটেন। তাঁরা ক্রিকেট বোঝেন না, কিন্তু মাটি বোঝেন। জানেন কোথায় বল ঘুরবে, কোথায় লাফাবে আর কোথায় থেমে যাবে।
তাঁরা পত্রিকায় আসেন না, কভার ফটো হন না, ট্রফি নেন না। কিন্তু বিশ্বের সেরা ব্যাটারদের খেলার মাঠ বানান তাঁরা। পি সারা ওভাল এখনও নিজের ঐতিহ্য ভুলে যায়নি। ড্রেসিংরুমে এখনও ঝুলে আছে সেই ছবি — ব্র্যাডম্যান আর কলম্বোর লোকাল বয় মাহাদেভান সাথাসিভাম টস করছেন।
তবে, পুরো মাঠ ঘুরে কোথাও ম্যারিয়াম্মার ছবি পাওয়া গেল না। আসলে ছবি খুঁজলে পাওয়া যাবে না ম্যারিয়াম্মাকে। তাঁর ইতিহাসের সাক্ষী দেয় পি সারা ওভালের প্রতিটা ঘাস আর মাটির কণা।