ফরাসি ফুটবলের রেনেসাঁস

সেদিন সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহুর্ত ছিল জিদান যখন মাঠ থেকে বিশ্বকাপের ট্রফি খুব পাশ দিয়ে হেটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ট্রফিটাও রাখা হয়েছিল ড্রেসিংরুমের করিডোরের বাইরে একটা খিলানের উপর। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিদানও হয়তো উপলব্ধি করেছিল এই ট্রফি তিনি আর জিততে পারছেন না।

‘ফ্রান্সে সবাই বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর আছেন। আর তিনি ফ্রান্স আর্ন্তজাতিক ফুটবল দলে ফিরে এসেছেন। ঈশ্বর ফিরেছেন, এর চেয়ে আর বেশী কী বলার আছে!’

অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসার পর জিদান সম্পর্কে সতীর্থ থিয়েরি অঁরি কথাটি বলেছিল। ফ্রান্স ফুটবলে তার গুরুত্ব বুঝানোর  জন্য হয়তোবা এই কথাটিই যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু, না।

ফ্রান্স ফুটবলে জিদানের গুরুত্ব আসলে তারচেয়েও যে বেশি! জিনেদিন জিদান ফ্রান্স ফুটবলের রেনেসাঁস; যার মাধ্যমেই ফরাসি ফুটবলে একটা বিপ্লব এসেছিল। ফ্রান্সে ফুটবলের প্রথম সুপারস্টার মিশেইল প্লাতিনি ফরাসি ফুটবল নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল; জিদান তারই পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন।

ইংলিশ ফুটবলার ডেভিড বেকহাম যার সম্পর্কে বলেন,

To train with Zidane for three years was a dream. For me, he is the greatest player of all time.

আমার আব্বু বলছিল, জিদান নাকি পুরো আপাদমস্তক একটা ফুটবলার ছিলেন!

আব্বু দিয়াগো ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনারই অন্ধ ভক্ত। প্রসঙ্গত, আমি যদি ভুল না বলি পৃথিবীর সবচেয়ে একনিষ্ঠ ফ্যানবেজ সম্ভবত দিয়াগো ম্যারাডোনার। আপনি দুনিয়ার সবকিছু খাওয়ায় দিলেও তারা কোনদিন ম্যারাডোনার লিগ্যাসি ভুলতে পারবে না।

টানা দুইটা বছর মাদ্রিদের রোনালদোর খেলা দেখিয়েও কোনদিন আব্বুর কাছে থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সামান্য প্রশংসা আদায় করতে পারিনি! যারা ৮৬’তে ম্যারাডোনার ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ দেখছে তাদের চোখে রোনালদো চ্যাম্পিয়নস লিগে বিখ্যাত বাইসাইকেলের গোল নাকি কিছুই না। লিওনেল মেসির যেকোন সলো গোলই তাদের কাছে নেহাত ক্ষুদ্র!

সেই পাড় ম্যারাডোনার ভক্ত যখন বলছে, ম্যারাডোনা পরবর্তী এখন পর্যন্ত মাত্র একজন ফুটবলারই দেখেছে যে ম্যারাডোনাকেও হয়তো ছাড়িয়ে যেতে পারত। তিনি জিনেদিন জিদান। বাবা বলেন, ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদান এতটা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ফুটবল খেলছিল ফাইনাল ম্যাচে যদি ‘ ঢুশ স্ক্যান্ডাল’ জড়িয়ে ট্রফিটা হাতছাড়া না করত তাহলে ফুটবল সম্রাট পেলে-ম্যারাডোনার সাথে হয়তো এতদিনে নিশ্চিত জিদানের নামটা চলে আসত। ওনার ভাষ্যমতে,

‘সেদিন সবচেয়ে মর্মান্তিক মুহুর্ত ছিল জিদান যখন মাঠ থেকে বিশ্বকাপের ট্রফির  খুব পাশ দিয়ে হেঁটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ট্রফিটাও রাখা হয়েছিল ড্রেসিংরুমের করিডোরের বাইরে একটা খিলানের উপর। সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিদানও হয়তো উপলব্ধি করেছিল এই ট্রফি তিনি আর জিততে পারছেন না। পুরো আসরে এতটা অসাধারণ পারফরম্যান্স করেও তার মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়াটা অনেক বেদনাদায়ক ছিল।’

আব্বু মনে হয় ভুলও বলে নাই।

আমি ২০০৬ বিশ্বকাপের ফ্রান্স এবং ব্রাজিলের অনেকগুলো ম্যাচ সংগ্রহ করে দেখি।

জিনিয়াস! একটা এট্যাকিং মিডফিল্ডারের জন্য তার চেয়ে বেটার পারফরম্যান্স করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। শুধুই স্ট্যাট দিয়ে জিদানকে বুঝানোও যাবে না; কেবল যারা জিদানের খেলাগুলো দেখেছেন  শুধুমাত্র তারা বলতে পারব জিদান আসলে কেমন ছিল।

আপনি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ম্যাচটা দেখুন শুধু। কি অসাধারণ একটা দলই না ছিল! অনেকের মতে, টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা একটি ছিল।

রোনালদো লিমা, কাকা,  রবিনহো,আদ্রিয়ানো, রবার্তো কার্লোস, কাফু, জুনিনহো, দিদা –কি ছিলনা দলটাতে? অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে টেকো মাথার এক জিদানের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে কত তাড়াতাড়ি টুর্নামেন্ট থেকেই বিদায় নিল। না, জিদান কোন গোল করেন নাই, ফ্রিকিক থেকে কেবল একটি অ্যাসিস্ট করেছিল;কিন্তু ব্রাজিলের বিপক্ষে বিশ্বকাপের মত আসরে একজন ফুটবলারের এতটা আধিপত্য আগে দেখে নাই কেউ। এটাই সম্ভবত বিশ্বকাপের ইতিহাসে ব্রাজিলের বিপক্ষে অন্যতম সেরা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল !

রোনালদো লিমার মাথার উপর দিয়ে বল নেয়া,তারপর কাকাকে ড্রিবলিংয়ে পরাস্ত করা, গিলবার্তো সিলভাকে হামাগুঁড়ি দেওয়া, রোনালদিনহোকে মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়ানো কিংবা কাফুকে ধোঁকা দেওয়া– সেদিন যেন জিদান যা ইচ্ছে সেটাই করতে পেরেছিল। ম্যাচ দেখেও মনে হয়েছিল, সেদিন ফরাসিদের দশ নম্বর জার্সি গায়ে কোন মানুষ খেলেনি; বরং দুনিয়ার বাইরে থেকে আসা কেউ খেলেছিল!

বর্তমানে আমরা দুই এক ম্যাচ দারুণ খেললে যে কাউকে ‘GOAT বা সর্বকালের সেরা’ ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছি। ভাগ্যিস, সেই সময়টাই ফেসবুকে এত রমরমা ছিল না। না হয় সবকিছু একত্রে বোধ হয় এই জিদানেরই নামের পাশে লাগিয়ে দেওয়া হইত। শুধু একবারই না, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটাকে ভুগিয়েছেন দুইবার।

প্রথমবার কোয়ার্টারে না; সেলেসাওদের কাঁদিয়েছিলেন সেবার ফাইনালেই। ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে জোড়া গোল করে একাই ব্রাজিলকে হারিয়ে ফরাসিদের এনে দিলেন প্রথমবার বিশ্বজয়ের স্বাদ! সেদিন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছিল,

“Allez les blues !  The story of  Zidane’s 1998 world cup triumph. “

বিখ্যাত ‘দ্য প্ল্যাকার’ তো শিরোনামই করে ফেললেন,

” Zidane, The Brazil slayer”

একবার ভাবুন তো, যদি টেকো মাথার এই লোকটা না থাকত; তাফারেলকে অসহায় করে ফ্রান্সের কেউ গোল  না পেত। হয়তো ব্রাজিলের নামের পাশে আরও দুইখানা বিশ্বকাপও যোগ হতে পারত। এতদিন সেলেসাওরা যে হেক্সা জয়ের স্বপ্নে বিভোর ব্রাজিলিয়ানদের সেই স্বপ্নটা  তো অনেক আগেই পূরণ হয়ে যেত। একজন জিদানের কাছে সেই স্বপ্নটাই শেষ হয়েছে দুবার। জিদান ব্যতিত বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ইন্ডিভিচ্যুয়ালি এতটা যন্ত্রণা দিতে পারে নাই আর কোন ফুটবলার।

মাঝেমধ্যেই ম্যাচগুলো হাইলাইটস দেখলে জিদানের প্রতি প্রচন্ড রাগ হয়;যদিও সেই রাগটাও বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারিনা। কারণ মাঠের খেলায় জিদানকে দেখার পর মনে হয়, এটা তার প্রাপ্য ছিল।এখানে তার চেয়ে বেশি যোগ্য দাবিদার আর কেউ নন!

জিনেদিন জিদান এক মহীরুহ। যার অস্থিমজ্জায় ছিল ফুটবল! খেলার মাঠে কিংবা মাঠের বাহিরেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার এক নিদারুণ স্নিগ্ধতায় মাতিয়েছিল পুরো ফুটবল বিশ্বকে। রাইভাল হোন কিংবা ফ্যান অসাধারণ সব ফুটবলশৈলী তাকে বানিয়েছে সবার প্রিয়পাত্র। ফুটবল, ফুটবল বিশ্বকাপ, ফ্রান্স কিংবা ব্রাজিল ফুটবলকে নিয়ে যত দিন আলোচনা হবে তার মধ্যে জিদান নামটাও যে অনেক উপরে উচ্চারিত হবে তা হলফ করে বলা দেওয়া যায়। স্কোলস সম্ভবত জিদানকে সবচেয়ে সুন্দরভাবেই বর্ণনা করেছিল,

To see Zidane in action was to witness poetry in motion. The skills, the vision,the goals . . . he was a sublime performer. When he was at his peak, winning the World Cup, the Champions League and all the rest, he was unquestionably the finest player on the planet.

জিনেদিন জিদানকে নিয়ে লিখতে বসলে অবশ্যই তার কিছু স্ট্যাট জানা জরুরি। আমার লেখাটাও শেষ করব জিদান সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে। যেমন,

(১) বর্তমানে মাদ্রিদিজমে জিদানের জায়গা অনেকটা উপরে বলা যায়। জিদান এখন মাদ্রিদিস্তাদের একটি অনুভূতির নাম। রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে জিদানের এত অর্জন; অথচ প্রথমজীবনে তার পছন্দের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ছিল না। শৈশবে রিয়ালের আর্চ রাইভাল বার্সাই জিদানের পছন্দের ক্লাব ছিল!

(২) প্রফেশনাল ফুটবল ক্যারিয়ারে প্রথম গোল করার পর উপহার পান একটি প্রাইভেট কার। ১৯৯২ সালেই ফ্রান্স ক্লাব ক্যানেসের হয়ে প্রথম গোল করার পর ক্লাব প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোজ জিদানকে এই উপহার দেন।

(৩) ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জোড়া গোল করে একাই ব্রাজিলকে হারিয়ে ফ্রান্সকে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতান জিদান। ইন্টারেস্টিং বিষয়, পুরো ক্যারিয়ারে শুধু ব্রাজিল ছাড়া অন্য আর কোন লাতিন আমেরিকান দলের বিপক্ষে গোল করার রেকর্ড নাই জিদানের ! ইভেন, ওই ম্যাচের পর লাতিন আমেরিকান কোন দলের বিপক্ষে কখনোই  গোলের দেখা পাননি জিজু।

(৪) দ্য গ্রেট পেলে, ভাবা,পল ব্রেইটনার সাথে যৌথভাবে দুটি ভিন্ন বিশ্বকাপ ফাইনাল গোল করা প্লেয়ার জিদান। ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের বয়স ছিল ৩৪বছর ১৬দিন। বিশ্বকাপে জিদানের চেয়ে বেশি বয়সে গোল্ডেন বলটা জিততে পারেনি আর কেউ !

(৫) ২০০৬ বিশ্বকাপে সেই “ঢুশ স্ক্যান্ডাল” এ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেও তা জিদানের জন্য প্রথম ছিল না! ৯৮ বিশ্বকাপেই প্রথম ফরাসি ফুটবলার হিসেবে সৌদি আরবের বিপক্ষে লাল কার্ডের  দেখা পান জিদান।পুরোটা ক্যারিয়ারে জিদান লাল কার্ডের দেখা পান আরও ষোল বার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে কাফু ও রাফায়েল মার্কেজের সাথে যৌথভাবে সর্বাধিক ৬টি কার্ড দেখা প্লেয়ারও হল জিদান।

(৬) ইতিহাসে কেবল একজন মাত্র ফুটবলার বিশ্বকাপ ও উয়েফা ইউরো টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। ইতিহাসে মাত্র একজন ফুটবলার খেলোয়াড় এবং কোচ উভয়েই IFFHS বেস্ট প্লেমেকারের এওয়ার্ড জিতেছেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে মাত্র একজন কোচ হ্যাট্রিক শিরোপা জিতেছেন। আর তিনি? তিনিই হলেন জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান।

(৭) ক্লাব এবং জাতীয় দল সবমিলিয়ে প্রায় ষোল বছরে জিদান ম্যাচ খেলেন ৭১৮টি। অবাক হলেও সত্য, এত  বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই অফসাইডে ট্র‍্যাপে পড়তে হয়নি তাকে।

(৮) রিয়াল মাদ্রিদ প্রথম ফ্রেঞ্চ কোচ জিনেদিন জিদান। রিয়াল মাদ্রিদকে সর্বাধিক ৭টি ইউরোপীয়ান ও ইন্টার. ট্রফি জিতানো কোচও জিদান।

(৯) মিডফিল্ডার জিদান ক্যারিয়ারে হ্যাট্রিক করেন মাত্র একটি। ২০০৬ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে শেষ মৌসুমে লীগে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে হ্যাট্রিকটি করেন।

(১০) জিদানের গোল নিয়ে কথা হবে; কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে লেভারকুসেনের সেই বলিতে করা গোল এর কথা আসবে না তা হতেই পারে না। ২০০২ উচলের ফাইনালে মাইকেল বালাকের বায়ার লেভারকুসেনেরর বিপক্ষে জিদান গোলটি করেছিলেন উইক ফুট বাম পা দিয়েই। গোল করার পর সেলিব্রেশনের সময়ে দৌড় দেন  প্রায় ৬০ মিটার. দূরত্ব। ২০১৭ সালের এক জরিপে এই গোলটি চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল ইতিহাসে সেরা গোল নির্বাচিত হয়।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির তুলির আচড়ে ফুটিয়ে তোলা সেই অনিন্দ্র সুন্দর চিত্রকর্মকে যেমন বিশ্লেষণ করা যায় না ; মার্বেল পাথরে তৈরী মমতাজ আর সম্রাট শাহজাহানের কীর্তি আগ্রার তাজমহল যেমন কোনভাবে বিশেষায়িত করা যায় না তেমনি একজন জিদানকেও কী-বোর্ডের কোনভাবে বর্ণনা করা সম্ভব না। জিদান বর্ণনার উর্ধ্বে।

উপভোগ করার সাধ্যে ফুটবল মাঠে তার অগাধ বিচরণ ছিল যেন কোন নিখুঁত জাদুকরের  জাদুমন্ত্র; ফুটবলে তার প্রতিটা স্পর্শ যেন জাদুকরের জাদুর পরশ। এখন Scorpions সেই বিখ্যাত গানের মতই বলতে ইচ্ছে হয়,

No one like you….Yes, No one like ZIZU !

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...