ট্রেভর চ্যাপেল অধ্যায়, বাংলাদেশের এক পা এগিয়ে দুই পা পেছানোর গল্প

গর্ডন গ্রিনিজ গেল, এডি বারলো আসলো। টেস্ট স্ট্যাটাস পেল বাংলাদেশ। এই টেস্ট জীবন শুরু করার আগেই স্ট্রোক করে হুইল চেয়ারে নিজের বাসা বাঁধলেন বারলো। সম্পর্ক ছিন্ন হল।

গর্ডন গ্রিনিজ গেল, এডি বারলো আসলো। টেস্ট স্ট্যাটাস পেল বাংলাদেশ। এই টেস্ট জীবন শুরু করার আগেই স্ট্রোক করে হুইল চেয়ারে নিজের বাসা বাঁধলেন বারলো। সম্পর্ক ছিন্ন হল।

আবার নতুন করে কোচ খোঁজা শুরু হল। বোর্ডেও পরিবর্তন আসলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল বিখ্যাত চ্যাপেল ভাইদের মাঝে সবার ছোট ট্রেভর চ্যাপেলকে। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন অনুজ্জ্বল ও বিতর্কিত ঘটনায় জড়িত। কোচিং জীবনেও ছিলেন অনুজ্জ্বল।

বাংলাদেশের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ছিলেন শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং কোচ। বাংলাদেশে এসে যেন তিনি ভুলেই গেলেন তিনি একজন হেড কোচ। এসেই হাত দিলেন দলের ফিল্ডিংয়ের দিকে। একটি নতুন টেস্ট দলকে এতে অভ্যস্ত না করে শুধুমাত্র ফিল্ডিং নির্ভর কোচিং করানোর দরুন খুব বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি সাথে বাংলাদেশকেও।

২০০১ সালের এপ্রিল, জিম্বাবুয়ে সফরে যাওয়ার আগে নিয়োগ দেয়া হয় চ্যাপেলকে। এন্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র‍্যান্ট ফ্লাওয়ার, এলিস্টার ক্যাম্পবেল আর হিথ স্ট্রিকের মত খেলোয়াড়দের সামনে কঠিন পরীক্ষায় পড়ে বাংলাদেশ। সেই সময় বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারেননি তিনি।

তার সাথে ক্রিকেটারদের আরেকটা সমস্যা হয়, সেটা হল যোগাযোগের। তার ভাষ্যমতে, তাঁর ভাষাই নাকি বুঝতে পারেন না ক্রিকেটাররা৷ অথচ তখনকার বাংলাদেশ দলের দুই-তিনজন নবীন খেলোয়াড় বাদে বাকীরা সবাই ভাল ইংরেজি বলতে বা বুঝতে পারতেন। যদিও এই ‘ভাষা সমস্যা’ নিয়েই কিন্তু গর্ডন গ্রিনিজ বা এডি বারলোরা কোচিং করিয়ে গিয়েছেন।

ট্রেভর চ্যাপেলের সময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে মাশরাফি বিন মর্তুজা নামক এক স্পিড মাস্টারের উত্থান। তবে মাশরাফির উত্থানের পেছনে চ্যাপেলের তো কোন হাতই ছিল না, উল্টো তাকে যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারেন নি। অতি ব্যবহারের কারণে মাশরাফির ক্যারিয়ারকে ইনজুরির দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে চ্যাপেলের অবদান কম নয়।

বাংলাদেশের টেস্ট যুগের শুরুতে দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের তিনি ব্যবহার করতে পারেননি ঠিক মত। তখনকার দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যান আকরাম খান আর আমিনুল ইসলামকে টেস্ট দলের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার দায় কিন্তু দিনের শেষে তার উপরই বর্তায়। অভীজ্ঞদের ছাড়া দেশের টেস্ট যাত্রা শুরু না হবার কারণেই হয়তো আজকের বাংলাদেশের টেস্ট ভিত্তিটা এতটা নড়বড়ে।

তবে, তিনি যে বাংলাদেশের জন্য কিছুই করেননি এইটা একদমই ভুল। তাঁর সময় গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের উন্নতি হয়। প্লেয়ারদের ফিটনেস সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের খেলোয়াড়দের মাঝে ‘অ্যাথলেটিসিজম’ এর বিষয়টা দৃশ্যমান হয়।

  • কে এই ট্রেভর চ্যাপেল?

ট্রেভর বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবারের ছেলে। পুরো নাম ট্রেভর মার্টিন চ্যাপেল, বিখ্যাত ইয়ান চ্যাপেল আর গ্রেগ চ্যাপেল এর ছোট ভাই। দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার প্লেনেগগে ১৯৫২ সালের ১২ অক্টোবর জন্ম নেন তিনি। তিনি একজন ডানহাতি অলরাউন্ডার।

খেলেছেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া আর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে। ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক হয় তার। কিন্তু পরে ১৯৭৬ সালে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দলের হয়ে খেলেন আর শেষে ১৯৭৯ সালে যুক্ত হন নিউ সাউথ ওয়েলস দলের সাথে।

  • ব্যাগি গ্রিনে ব্যর্থ

১৯৮১ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে যখন নিজের সাবেক দল অর্থাৎ পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রানের ইনিংস খেলেন আর তখনই অ্যাশেজ সিরিজের জন্য দলে ডাক পড়ে এই ট্রেভল চ্যাপেল এর। কিন্তু না তিনি ব্যর্থ, শুধু ব্যর্থ না চরমভাবে ব্যর্থ। যার ফলে চিরকালের জন্য বাদ পড়েন অজি টেস্ট দল থেকে। উনি তার খেলোয়াড়ী জীবনে টেস্ট খেলে করেন মাত্র ৭৯। সর্বোচ্চ ২৭ রান।

ফলে, কখনোই আর সাদা পোশাকে তাঁর ফেরা হয়নি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে খেলেছেন মাত্র ২০টি ওয়ানডে আর সর্বমোট ২২৯ রান। সর্বোচ্চ করেছেন ১১০ রান ভারতের বিপক্ষে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও নেই তেমন কোনো সাফল্য। ৮৮ ম্যাচে ৪০৪৯ রান। যার মাঝে ৫ টি সেঞ্চুরি আর ২১ টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে।

অথচ, এই ছোট্ট ক্যারিয়ারেই অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ইতিহাসে কাঁপিয়ে দেওয়া বিতর্কে নাম আসে তাঁর। সেই গল্পই এখন বলতে চলেছি।

  • আন্ডারআর্ম বিতর্ক ও ট্রেভর চ্যাপেল

ইয়ান চ্যাপেল, গ্রেগ চ্যাপেল আর ট্রেভর চ্যাপেল অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত তিন ভাই। ১৯৮১ সালের এক ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে ঘটে যায় এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা আর যার সাথে জড়িয়ে পড়েন তিন ভাইয়ের দুই ভাই গ্রেগ ও ট্রেভর চ্যাপেল।

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) অনুষ্ঠিত বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া। সিরিজ তখন ১-১ এ সমতা বজায় আছে। ২৩৫ রানে ব্যাট করতে নেমে ১ বলে ৭ রান প্রয়োজন তখন স্ট্রাইক প্রান্তে নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যান ব্রায়ান ম্যাককেনি ছক্কা হাঁকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

কুখ্যাত সেই আন্ডারআর্ম ডেলিভারি

আর বোলিং প্রান্তে তখন অজি বোলার ট্রেভর চ্যাপেল। এমন সময় অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেলকে আন্ডার-আর্ম বোলিংয়ের জন্য নির্দেশ দেন। জবাবে ট্রেভর মহাশয় আন্ডার-আর্ম বোলিং করতে পারেন না বলে জানান।

উত্তরে গ্রেগ জানান, একমাত্র এইভাবেই বোলিং করতে হবে। গ্রেগের পরামর্শে আম্পায়ার বোলিংয়ের ধরণ পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। কিন্তু এতে বাঁধ সাধেন উইকেটরক্ষক রডনি মার্শ। মার্শের আপত্তি আগ্রাহ্য করে গ্রেগ মাঠে বল গড়িয়ে বোলিং করেন আর ম্যাককেনি তা ঠেকিয়ে দিয়ে রাগে ব্যাট ছুঁড়ে ফেলেন।

ধারাভাষ্যকার হিসেবে তখন ছিল তাদের বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল আর তিনি তখন গ্রেগকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘না, গ্রেগ না, তুমি এমনটি করতে পারো না।’

ক্রিকেটের তৎকালীন সকল নিয়ম মানার পরেও ভয়ানক নিন্দার ঝড় ওঠে অস্ট্রেলিয়ার উপর। জয় নিয়া মাঠ ছাড়লেও শুনতে হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শকের দুয়োধ্বনি।

  • বাংলাদেশ অধ্যায়ের ইতি

২০০১ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুয়ে সফর দিয়ে তার শুরু। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০২ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। এই এক বছরে বাংলাদেশ খেলেছে তিনটি সিরিজ। ঘরের মাঠে দুটি আর বিদেশে একটি।

এই তিনটি সিরিজেই দলের বাজে অবস্থা দেখে বিসিবি ট্রেভরের চুক্তি না বাড়ানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। গর্ডন গ্রিনিজ, এডি বারলো আমাদের যতটানা এগিয়ে দিয়েছে তার দ্বিগুন পিছিয়ে দিয়েছে ট্রেভর চ্যাপেল। আর এই ক্ষতি আমাদের পূরণ করতে বেশ সময়ই লেগেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link