লুকা মদ্রিচকে নিয়ে লেখা আমার হয় না। ঠিক যেমন রুদ্রর কবিতা পড়লে মনে কোনও ভাবনা আসে না। শুধু বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো, আধো-অল্প হাওয়া, কানের কাছে ফিসফাস। কেউ বলে যায়, এখনও আমি আছি। ফুরিয়ে যাইনি। আমি বিশ্বাস করি, তাই পরের স্বপ্নটা দেখতে আরও ইচ্ছে হয়।
মদ্রিচকে নিয়ে গড়পড়তা ভাবে লেখার কিছু আছে বলেও মনে করি না। এক একটা সন্ধ্যেকে যেমন কাব্যে উপস্থাপন করা যায় না। একটা পাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেও মনে হয় না সময় বেরিয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে পাত্তর, আর তো কয়েকটা ঘণ্টা। মনে হয় না। মদ্রিচ ঠিক তেমনি। পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী তরুণী।
লুকিয়ে খুঁজে ফেরার মধ্যে একটা ছোট্ট প্রেম বাসা বেঁধে আছে। গোটা মাঠে তার অদ্ভুত বিচরণ। সে অতিনায়কও নয়, আবার তাকে ছাড়া মনে হয় শূন্যতার অভিঘাত। মদ্রিচ তেমনই এক নাম না জানা প্রেমিকা। যে সামনে থাকলে চোখে না পড়লেও চলে, অথচ না থাকলে চোখ খুঁজে ফেরে অবিরাম।
আর নায়ক কে, অতিনায়কই বা কে – যে বছর বছর ব্যালন ডি অর পায়? যার মাঠে একঝলকের উপস্থিতি টিভি চ্যানেলগুলোর সর্বোচ্চ টিআরপির কারণ? হয়তো তাই। গোল্ডেন বল পেয়ে মদ্রিচ তিন বছর আগেই নায়কের তাজ পেয়েছে। দলকে সোনার বিশ্বকাপ দিতে না পারলেও গোটা বিশ্বে কম করে লক্ষ আর্টিকেল লেখা হয়েছে তার অধীনস্থ ক্রোট দলটিকে নিয়ে।
অমন প্রদর্শনের ছাপ গভীরভাবে পড়েছে কোটি কোটি ফুটবলপাগল মানুষের মনের মণিকোঠায়। অথচ মদ্রিচ তো নায়ক হতে আসেনি। কলোভেয়োর হোটেল ওকে নায়ক হতে শেখায়নি। ওর দাদুর হত্যা, পরিবার পালিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া – এ সব তো নায়ক হওয়ার উপকরণ নয়। এ দহনে ভরা বাল্যকাল যে দেখেছে, তার যাত্রাপথে নায়ক শব্দটা খাটে না।
এ স্বপ্নালু চেহারাগুলো ছবি আঁকে, গান গায়, কবিতা লেখে। নাটক-উপন্যাসের সবচেয়ে লড়াকু শিল্পী হিসেবে থেকে যায় একটু পিছনের সারিতে। মদ্রিচ তাই। ছোট বোনকে ফেলে রেখে আসার সময় যে কান্না, সেটাই ঐ শিল্পীকে গড়ে তুলেছে। ঐ পরের স্বপ্নটা দেখার শুরু। জাডার আর ডায়নামো জাগ্রেবে জুনিয়র কেরিয়ারের সময়ও ছিল, আজ মধ্য তিরিশে পৌঁছে রিয়ালের নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার হয়েও আছে।
শুধু বয়সটা জানান দিচ্ছে, আর ট্যাকল নয়, আর বলকে ধাওয়া করে গোটা মাঠে ছোটাছুটি নয়। যতদিন আছি, ততদিন আমি খেল দেখাব। শিল্পকে সঙ্গী করে। তাই কেরিয়ারের অস্তে পৌঁছনো বছর পঁয়ত্রিশের লুকা মদ্রিচের এখন সম্বল শুধুই শিল্প। হালকা বল বাড়ানো বা শরীরের ছোট্ট টার্নে ড্রিবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন তিনি। আর আগুন নয়, আর ফেলে আসা ক্রোয়েশিয়ান যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে চোখদুটোকে নিরর্থক জ্বালানো নয়।
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি, সোনার খাঁচায় রইল না। সে সোনার দিনের ম্যানজুকিচ, রাকিটিচ নেই। কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে পড়া মদ্রিচের নিজের হাঁটুও জানান দিচ্ছে, ইটস অল ওভার ডুড। বিলায়েত খাঁর সেতারেরও একটা শেষ তারানা থাকে। সেটাই এই ইউরো কাপে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোলটা। কোপেনহেগেনের মাঠ তারপরেই প্রশ্নপত্র ফেলছে, আর ইউ অ্যাবল টু কন্টিনিউ ইওর ক্যারিয়ার?
উত্তরটা জানা। রিয়ালের হয়ে শেষ মৌসুমটা কাটুক। তারপর তো হেয়ারব্যান্ড থাকলই, ফুটবলের কাছে বাও করার জন্য।