মনসুর স্পোর্টিং ক্লাবের মনসুর ভাই

একেবারে সাংবাদিকতা শুরুর দিকের ঘটনা।

তখনও ই-মেইল জনপ্রিয় হয়নি, হোয়াটস অ্যাপ বা ফেসবুক এসে পারেনি। ফ্যাক্স মেশিনের কট কট শব্দে অফিসে পৌছাতো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। একটু পরপর এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির একটা বান্ডিল ক্রীড়া বিভাগে নিয়ে আসতেন কেউ। আর এই বান্ডিলের মধ্যে প্রতিদিনই খুজে পাওয়া যেতো একটা নাম-মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব।

কোনো দিন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব এই খেলা আয়োজন করছে, কোনোদিন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবল বা ক্রিকেট দল কোথাও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিংবা কোনো গুনী খেলোয়াড়ের প্রয়ানে মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব শোক প্রকাশ করেছে।

সত্যি বলি, ব্যাপারটা বিরক্তিকর ছিলো। এই নিউজ ছাপা খুব একটা হতো না। তারপরও রোজ চোখের সামনে গন্ডা গন্ডা একই ধরণের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি।

একদিন আমি বিরক্তিটা প্রকাশই করে ফেললাম। তখন পাশেই দাড়িয়ে ছিলেন, বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার দিকপাল পবিত্র কুন্ডু। তিনি হেসে বললেন, ‘মনসুরের ওপরে বিরক্ত হবেন না। সে খেলাটাকে ভালোবেসে এইসব করে। তার এই ছোটাছুটির মধ্যে কোনো লাভের মোহ নেই। ও স্রেফ খেলাপাগল একটা মানুষ।’

হ্যা, সত্যিকারের খেলাপাগল বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন মনসুর আলী। এই খেলা পাগলামির জন্য সংসার করেননি। এই খেলা পাগলামির জন্য সাড়ে তিন দশক ধরে নিজে নিজে চালাচ্ছিলেন এক স্পোর্টিং ক্লাব। এই খেলা পাগলামির জন্যই ছুটে বেড়িয়েছেন সব ফেডারেশন, সব সংবাদ মাধ্যমের অফিসে। অবশেষে সব পাগলামি থেমে গেলো। খেলার এই ছোট্ট জগত থেকে চলে গেলেন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাবের মনসুর আলী।

একটা সময় বাংলাদেশ জুড়ে এমন ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন প্রতিটা পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে। ঘরের টাকা ব্যয় করে খেলা চালানোর জন্য এমন সব লোকেরাই ধরে রেখেছিলেন খেলাটা। তাদের কল্যানেই পাড়ায় পাড়ায় টিকে ছিলো ক্লাব সংষ্কৃতি। আর এই বনের মোষ তাড়ানো সংগঠকদের শেষ প্রজন্মের প্রতিনিধি ছিলেন মনসুর ভাই।

মনসুর ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ফুটবল ফেডারেশনে।

বিশেষ কিছু না। সাংবাদিক বলে একটা খবর ছাপতে অনুরোধ করেছিলেন, মোবাইল নম্বর রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে ফোন করে সংবাদ ছাপানোর অনুরোধ করতেন। বলতেন, ‘আমার জন্য বলতেছি না। পোলাপাইনগুলো নিউজ দেখলে আনন্দ পায়।’

এটা সত্যি, এই খেলার পোলাপাইনের জন্যই জীবন উৎসর্গ করে দিলেন।

পুরোনো ঢাকার মানুষ ছিলেন। পত্রিকান্তরে জানা গেলো, সিদ্দিক বাজারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মনসুর আলীর। সেখানে তাদের খাবার হোটেল, জুতার দোকান ছিলো। সাধারণ নিয়মে সেই সব ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার কথা ছিলো। কিন্তু মনসুর ভাইকে বেঁধে ফেললো খেলার নেশা। নিজে সম্ভবত লেখাপড়ার মত খেলাও বেশিদূর করতে পারেননি। হয়ে উঠেছেন খেলোয়াড় তৈরীর সংগঠক।

১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব। একটা দুটো নয়, ছয়টা খেলা পরিচালনা করতো এই ক্লাব-ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, টিটি, ব্যাডমিন্টন ও রাগবি। এই ক্লাবের খেলোয়াড় পাওয়ার জন্য অভিনব কায়দা ছিলো মনসুর ভাইয়ের।

বিভিন্ন জেলার স্টেডিয়ামে চলে যেতেন। খেলা দেখতেন। বিভিন্ন গ্রামের রাস্তা ধরে ঘুরতেন। পাশে কোনো মাঠে খেলা হতে থাকলে বসে পড়তেন। কোনো খেলোয়াড়কে মনে ধরলে ধরে নিয়ে আসতেন ঢাকায়। নিজের ক্লাবে রাখতে পারলে রেখে দিতেন। আরেকটু যোগ্য মনে হলে অন্য কোনো ক্লাবে বলে কয়ে ঢুকিয়ে দিতেন। অনেক ক্লাবেরই খেলোয়াড় পাওয়ার প্রাইমারি সোর্স ছিলো এই মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব।

মনসুর ভাইয়ের বড় ফোকাস ছিলো ফুটবলে। গত ৩৫ বছর ধরে পাইওনিয়ার লিগে ‘মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব’ খেলছে। চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই বহু আগে তার দল তৃতীয় বিভাগে উঠে আসতো। কিন্তু টাকার অভাবে সেই চেষ্টা করেননি মনসুর ভাই। পাইওনিয়ার লিগে লাখের নিচে দল করা যেতো। তৃতীয় বিভাগে সেই অংকটা বেড়ে যায় বলে কখনো সে চেষ্টা করেননি মনসুর আলী।

সবই অতীত হয়ে গেলো।

মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব হয়তো আর কখনো লড়াই করবে না। আর কেউ মনসুর স্পোর্টিং ক্লাবের একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ছুটবে না। পান খেয়ে লাল করা মুখটা নিয়ে কেউ আর হেসে সামনে এসে দাড়াবে না। বিশাল ফিরিস্ত দেওয়া একটা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে কেউ বলবে না, ‘এটা রাইখে দেন। পারলে ক্লাবের নিউজ দিয়েন।’

একটা যুগই হয়তো শেষ হয়ে গেলো মনসুর ভাইয়ের সাথে। ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ক্রীড়া সংগঠকদের শেষ প্রতিনিধির বিলোপ হলো যেনো মনসুর ভাইয়ের সাথে সাথে।

ভালো থাকবেন, মনসুর ভাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link