চেলসিকে বদলে দেওয়া পরশপাথর

এই বছরের একদম শুরুতে যদি চেলসির কোনো পাড় ভক্তকেও বলতেন এই মৌসুম তারা চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল খেলবে, হেসে উড়িয়ে দিতো তারা। সমর্থক হিসেবে দলের প্রতি চাওয়া পাওয়া থাকে অনেক। সেজন্য নিজেদের দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্ন দেখাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের চেলসি চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে খেলবে, এমনটা ভাবা বেশ দু:সাধ্যই ছিল। সেটাকেই সত্যিতে পরিণত করেছেন থমাস টুখেল। ল্যাম্পার্ডের রেখে যাওয়া চেলসিকে তুলে এনেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে। এমনকি প্রিমিয়ার লিগেও চারে ফেরার জন্য প্রচেষ্টা কম নয়। হঠাৎ করে কী এমন জাদুর স্পর্শে বদলে গেল ব্লুজরা?

চেলসি মৌসুম শুরু করেছিল লিজেন্ড ফ্র্যাংক ল্যাম্পার্ডের হাত ধরে। শুরুটাই হয়েছিল শেকি, ছোট দলের সাথে ঠিকই জয় বের করে নিচ্ছিলেন, কিন্তু বড় দলের মুখোমুখি হলেই যেন চেলসি হয়ে পড়েছিল কূলহারা তরী। মৌসুমের শুরুতেই প্রায় ২৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি খরচ করে ৫ জন খেলোয়াড় ভিড়িয়েছিল স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি তাদের। বরং পাঁচ বড় বড় ট্রান্সফার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে ল্যাম্পার্ডকে। দলকে নিয়ে নামতে নামতে একসময় অস্টম পজিশনেও চলে গিয়েছিলেন তিনি।

ফুটবলের সবচেয়ে অধৈর্য্যশীল বোর্ডের কথা আসলে সেখানে সবার আগে নাম আসবে চেলসি বোর্ডের। ২০০৪ সালে রোমান আব্রামোভিচ আসার পর থেকে চেলসির ডাগআউট যেন রোলিং চেয়ার। কখন কে বসবেন তার ঠিক নেই, সাফল্য না পেলেই ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা নেই বিন্দুমাত্র। তাদের সেরা কোচ খোদ জোসে মোরিনহোই বরখাস্ত হয়েছেন দুইবার! সেখানে ল্যাম্পার্ড সুযোগ পেয়েছিলেন অনেকটা সময়, কিন্তু আর সময় দেওয়ার চলছিল না চেলসির। সেজন্য তড়িঘড়ি করে তাকে বিদায় বলে দলে টানা হলো থমাস টুখেলকে।

টুখেলের অবস্থাও বলার মতন কিছু ছিল না, সিভিতে বড় বড় ক্লাবের নাম আছে ঠিকই। কিন্তু অবস্থাটা ভালো ছিল না। ক্রিসমাসের দিন বরখাস্ত হয়েছেন পিএসজি থেকে। যতটা না খেলার কারণে, তার থেকে বেশি ড্রেসিংরুম হারিয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলিয়েছেন গত মৌসুমে, তার উপর জার্মান। দলে নতুন আসা জার্মান ত্রয়ীর জন্য বেশ সুবিধাজনক সেটা। কিন্তু হুট করে ক্লাব লিজেন্ড থেকে এক্সপেরিয়ান্সড কোচে মুভ করেই কী রাতারাতি বদলে গেল লন্ডন ব্লুজরা?

সত্যি বলতে অনেকটা তাই-ই। টুখেল আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত হারের স্বাদ পেয়েছেন মাত্র ২ ম্যাচে। একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে, যেখানে প্রথম লেগেই এক পা দিয়ে রেখেছিল সেমিতে। আরেকটি ওয়েস্ট ব্রমের সাথে ৩-৫ গোলে! বলতে গেলে শুধুমাত্র এই একটি ম্যাচেই নিজের খেলার ছন্দ হারিয়েছিলেন টুখেল। পোর্তোর বিপক্ষে হারের দিন পুরো ম্যাচটাই ছন্দে খেলেছিলেন শেষ মুহুর্তের অসাধারণ গোল বাদে। ডিফেন্স আর অ্যাটাকের মধ্যে অদ্ভুত এক সমন্বয়ও খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

ল্যাম্পার্ডের আমলে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল এই অ্যাটাক আর ডিফেন্সের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া নিয়ে। ল্যাম্পার্ড পুরো মৌসুম কাটিয়েছেন কোনো সমন্বয় ছাড়া। ডিফেন্স আর মিডফিল্ডের মাঝের গ্যাপ ছিল বিশাল, পারেননি মিডফিল্ড আর অ্যাটাকের মধ্যে কোনো সমন্বয় করতে। আগের মৌসুমে ট্রান্সফার ব্যান থাকার নতুন কোনো খেলোয়াড় কেনা সম্ভব হয়নি। ফলে ইয়ুথ খেলোয়াড়দের ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে দলকে চ্যাম্পিয়নস লিগেও উঠিয়েছেন। কিন্তু যখনই দলে নতুন নতুন রসদ এসেছে, তখনই আর তাদের দলে ফিট করাতে পারছিলেন না। বলা বাহুল্য এদের মধ্যে অনেকেই ল্যাম্পার্ডের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না, বরং চেলসির ট্রান্সফার ওভারসি করা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মারিনা গ্র্যানোভস্কিয়ার ট্রান্সফার ছিল সেগুলো। ফলে দলে অন্তর্দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছিল কিছুটা। কিন্তু তা আমলে নেননি টুখেল। নেওয়ার সুযোগও ছিল না। জানুয়ারির একদম শেষ সময়ে এসে ট্রান্সফার করার সুযোগও ছিল না।

পিএসজিতে থাকতেই তার তুরুপের তাস ছিলেন থিয়াগো সিলভা, এখানেও তার উপরে ভরসা রেখেছেন। দলকে খেলানো শুরু করলেন ৩ ম্যান ডিফেন্সে। নিয়মিত ফরমেশন হতে থাকলো ৩-৫-২, ৩-৪-২-১। ৪ ম্যান ডিফেন্সে দুই উইংব্যাককে বেশিরভাগ সময়ে আক্রমণে সাহায্য করতে হতো। আর তখনই উইং দিয়ে অ্যাটাকের সুযোগ পেত প্রতিপক্ষ। কিন্তু ৩ ম্যান ডিফেন্সে তাদের একমাত্র লক্ষ্যই থাকে ডিফেন্স ধরে রাখা, ফলে ফরমেশন চেঞ্জ করেই দলের ডিফেন্স শক্ত করে ফেলেন টুখেল।

এবার প্রশ্ন আসে টুখেলের অ্যাটাকিং মাইন্ড সেটাপে। টুখেলের জন্য অপশনের অভাব ছিল না। জার্মানি থেকে আসা তিন খেলোয়াড়; কাই হাভার্টজ, টিমো ভের্নার আর ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ (পুলিসিচ আমেরিকান হলেও দুইবছর খেলেছেন ডর্টমুন্ডের জার্সিতে) যারা দলের সাথে মানিয়েই নিতে পারছিলেন না, বরং ম্যাচের পর ম্যাচ খাতাপ খেলা এবং ল্যাম্পার্ডের ইয়ুথ প্লেয়ারদের সুযোগ দেওয়া তাদের মোর‍্যাল আর কনফিডেন্স দুটোই ডাউন করে দিয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু টুখেল এসেই ভেঙ্গে দেন তাদের ভাষাগত পার্থক্য। ফলে জার্মান খেলোয়াড়েরা আরো ফ্রি হতে পেরেছে কোচের সাথে, সুযোগও পাচ্ছে নিজেদের খেলা দেখানোর। ফলে এতোদিন নিজেদের ছায়া হয়ে থাকা কাই হাভার্টজ কিংবা টিমো ভের্নার রাতারাতি বদলে গিয়েছে টুখেলের আগমনের পরে।

থ্রি-ম্যান ডিফেন্সের সামনে দুইজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার খেলানো টুখেলের মাস্টারস্ট্রোক। আগে ফোর-ম্যান ডিফেন্সে দুই পাশ থেকে উইংব্যাক উঠে গেলে দেখা যেত দুই পাশ দিয়েই প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং চান্স বেড়ে যেত, কিন্তু এখন তা কমে এসেছে অনেকখানি। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছেন আক্রমণভাগে!

চেলসিতে কখনোই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। নামের অভাবও নেই। থ্রি-ম্যান-ডিফেন্স খেলানোর কারণে চেলসির অপশন তৈরি হয় সামনে আরো বেশি খেলোয়াড় খেলানোর। নিত্যনতুন ফরমেশন, ট্যাক্টিকস খাটানোর। এমনকি পুরাতন সৈনিকেরা, যাদের ল্যাম্পার্ড বাতিলের খাতাতেই ফেলে দিয়েছিলেন, তাদের উত্থানও ছিল চোখে পরার মতন। বামপাশে মার্কো আলানসো, ডিফেন্সে ক্রিশ্চেনসেন, রুডিগার, অ্যাটাকে হাডসন ওডোই। ফলে প্রতি ম্যাচে চেঞ্জ আনা, দলের খেলোয়াড়দের নিয়মিত চ্যালেঞ্জ জানানো বড় ইম্প্যাক্ট ফেলেছে দলের উপর।

কোনো খেলোয়াড় বাজে পারফর্ম করলে তাঁকে সরিয়ে আনতে দুবার ভাবছেন না তিনি। কারণটা সোজা, তোমাকে টুখেলের দলে থাকতে হলে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েই থাকতে হবে, নইলে তোমার জায়গা বেঞ্চে। যেমনটা ফেইস করেছেন ট্যামি আব্রাহাম, গত মৌসুমের সেরা স্ট্রাইকারকে দুইবার হাফ টাইমে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়েছেন টুখেল। দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের মধ্যে ফাইটিং স্পিরিট আনার চেষ্টা করেছেন টুখেল। এবং সে জায়গাতে তিনি সফল। তাঁর ১৪ বছরের কোচিং ক্যারিয়ার সফল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link