প্রত্যাবর্তনের প্রতীকায়ন

❝ও আমাদের বিপক্ষে খেলছে, তাকে পাস দিও না।❞

করিম বেনজেমার এই কথাটাই ভিনিসিয়াস জুনিয়রের শুরুর কয়েক বছরের প্রতিচ্ছবি। অবিশ্বাস্য গোল মিস, বারবার বলের দখল হারানো ছিল ভিনি জুনিয়রের খেলার অংশ। হঠাৎ করে দেখলে আসলেই মনে হতো এই ছেলে বুঝি নিজের দলের বিপক্ষেই খেলছে।

স্বাভাবিকভাবেই নিজ ক্লাবের ভক্তদের কাছে তিরস্কৃত হয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকে ট্রল করা হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু আশাহত হননি ভিনিসিয়াস। হতাশ হয়ে ক্লাব না বদলে বরং বদলেছেন খেলার ধরণ, নিজেকে করেছেন আরো ক্ষুরধার। যে বেনজেমা অন্য সতীর্থদের বারণ করেছিল তাকে পাস দিতে, সেই বেনজেমাকে নিয়েই দুর্দান্ত জুটি গড়ে রিয়াল মাদ্রিদকে গত মৌসুমে এনে দিয়েছেন লা লিগা আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। 

গত মৌসুমে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন কেউ বোধহয় নেই। একরোখা আর সংকল্পবদ্ধ ভিনির পায়ে বল যাওয়া মাত্রই নড়েচড়ে বসেছে গ্যালারির দর্শকেরা। চিতার মত গতি আর ম্যাজিক্যাল ড্রিবলিং; দুই পায়ের জাদুতে ডিফেন্ডারদের বোকা বানানো কোন ব্যাপারই ছিল না তাঁর কাছে। সবমিলিয়ে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের জার্সিতে এই ব্রাজিলিয়ান ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।

এই লেফটউইঙ্গার এখন বাম পাশ থেকে চোখের পলকে চলে যেতে পারেন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে। এরপর কখনো খুঁজে নেন সতীর্থকে, কখনো নিজেই জালের সন্ধান পেয়ে যান। অথচ একটা সময় এই বক্সের ভিতরে অসহায় হয়ে পড়তেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। পুরো মাঠ দাপিয়ে এসে ডি-বক্সের ভিতরে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। আবার কখনো শট না নিয়ে অহেতুক ড্রিবলিং করেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে ঠেলে দিতেন।

২০১৮ সালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর রিয়াল মাদ্রিদের পুনর্গঠনে নজর দিয়েছিল ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। এরই অংশ হিসেবে ব্রাজিলের ফ্লামেঙ্গো থেকে নিয়ে এসেছিলেন ভিনি জুনিয়রকে। মাঠের পজিশন আর খেলার ধরণের মিল থাকায় অনেকে আশা করেছিলেন হয়তো পর্তুগিজ তারকার অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করবেন তিনি। অথচ গোলকিপারকে একা পেয়েও বল পোস্টের বাইরে দিয়ে মারা কিংবা পাস দিতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলার মত ভুল করতে শুরু করেন ভিনি।

রোনালদোর মত খেলা তো দূরে থাক, স্পেনে আসার পর নিজের সহজাত খেলাই ভুলতে বসেছিলেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার। এর মাঝেও অবশ্য দুই এক ম্যাচে নিজের সামর্থ্যের ঝলক দেখিয়েছিলেন, কিন্তু বড্ড অধারাবাহিক ভিনি জুনিয়রকে সহ্য করতে পারছিলেন ভক্ত-সমর্থকরা। অবজ্ঞার এই গল্পটা ২০২১ পর্যন্ত। নতুন মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পাল্টে যায় ভিনি জুনিয়রের খেলা।

মূলত ভিনি জুনিয়রের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন অভিজ্ঞ কোচ কার্লো আনচেলত্তি। এই ইতালিয়ান দায়িত্বে আসার পরেই ভিনিকে মাঠের বামপাশটা অলিখিতভাবে দিয়ে দিয়েছিলেন, বলতে গেলে অটো চয়েজ হিসেবেই ভিনিকে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। আর কোচের ভরসা হাত কাঁধের উপর পেয়েই আমূল বদলে গিয়েছেন ‘সাম্বা বয়’। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন, ডি-বক্সে নিজেকে শান্ত রাখতে শিখেছেন। এখনো হয়তো পুরোপুরি নিঁখুত হয়ে উঠেননি ভিনি, তারপরও বর্তমান সময়ে যেকোনো দলের জন্য বড় দুশ্চিন্তা এই তরুণ।

২০২০/২১ লা লিগাতে ৩৫ ম্যাচে তিন গোল করা ভিনিসিয়াস জুনিয়র, পরের মৌসুমে সমান ম্যাচ খেলে করেছেন ১৭ গোল। এর পাশাপাশি আরো দশটি অ্যাসিস্ট তো আছেই। সংখ্যাতেই স্পষ্ট ভিনির উন্নতি। আবার ট্রান্সফার মার্কেটে সবচেয়ে দামি ফুটবলারের মধ্যে অন্যতম তিনি। আর পর্দায় চোখ রাখলে নিজের চোখেই দেখা যায় এই ইয়াং স্টারের কারিশমা। আবার নেইমার জুনিয়রের অফ ফর্মের কারনে কেউ কেউ তো ভিনিকে বর্তমান ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড় মনে করেন।

ভিনিসিয়াস জুনিয়র এখন নামেই শুধু জুনিয়র, খেলার মাঠে তিনি আস্ত এক দানব বটে। তিনি জানেন তিনি কি করতে পারেন, তিনি কি করবেন। দক্ষ সুরকারের মতই পায়ের তাল আর ছন্দে তিনি সৃষ্টি করেছেন মোহনীয় সুর!

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিতে ম্যানসিটির ফার্নান্দিনহোকে দেয়া সেই ডজ অথবা এমন কিছু মূহুর্ত আর মাদ্রিদের ব্যাজের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কারণে ইতোমধ্যে ভক্তদের চোখের মনি হয়ে গিয়েছেন ভিনি। শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এক মৌসুম; ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে দেখা যাবে আরো দুর্ধর্ষ রূপে – এমনটাই প্রত্যাশা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কোটি মাদ্রিদিস্তাদের। ২৩ বছরে পা দেওয়া ভিনিসিয়াস জুনিয়রও নিশ্চয়ই তেমনি করেই নিজেকে গড়ে তুলছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link