তেসরা জুন, আহমেদাবাদ। রাত তখন গড়িয়েছে অনেক দূর। তবু স্টেডিয়ামের আকাশজুড়ে আতশবাজি, মানুষের উল্লাসে ফুটে উঠছে ইতিহাসের এক নিঃশব্দ মুহূর্ত। মাঠের ঠিক মাঝখানে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছেন বিরাট কোহলি, মুখ ঢেকে রেখেছেন দুই হাতে।
যেন আরেকটি গল্প মনে করিয়ে দিলেন — ২০২২-এর সেই লিওনেল মেসির মুখ। সেই একই ভঙ্গি, সেই একই অশ্রু। দুটি খেলাই আলাদা, দুটি মঞ্চও ভিন্ন। কিন্তু অনুভূতির ভাষা যে এক— যেখানে অপেক্ষা, ত্যাগ আর স্বপ্নের ওজন মিশে যায় একই রঙে।
একটা ট্রফিই যেন জীবনের যত আক্ষেপ। ওটা না পেলেই যে নয়, ওটা না পেলে যে কিংবদন্তি হলেও সেরা হওয়া যায় না। লিওনেল মেসি পেয়েছিলেন ১৭ বছরের অপেক্ষার পর আর কোহলির অপেক্ষা ছিল ১৮ বছরের৷ তবে দুজনের প্রাপ্তির খাতা যে ভিন্ন ছিল।
বিরাট কোহলি যাকে বলা হয় বাইশ গজের রাজা। ব্যাট হাতে শাসন করেছেন, দুনিয়ার তাবড়-তাবড় বোলারদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন একটা কভার ড্রাইভে। ক্যারিয়ারে সব পেয়েছেন, বড় মঞ্চের বিশ্বকাপও তো ওই ঝুলিতে আছে। আধুনিক ক্রিকেটের সাম্রাজ্য গড়েছেন নিজের হাতে, যেখানে একছত্র অধিপত্যে তাঁর।
তবে দু:খটা ছিল তো একটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টের ট্রফি। যার জন্য লুকিয়ে কেঁদেছেন, যার জন্য ১৮ বছরের অভিমান লুকিয়ে ছিল ওই ১৮ নম্বর জার্সিতে। ওই তো ২০১৬-এর ফাইনাল হেরে গিয়ে, এমনই এক উৎসবমুখর রাতে বলে উঠেছিলেন ‘বিধাতা আর কত!’
অবশেষে ওই আহমেদাবাদ তাকে সব দিল। শেষ বলটা যখন শেষ হলো কোহলি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন সবুজ গালিচায়। দু’হাতে ঢেকে রাখা মুখ, চোখের অশ্রুটা হয়তো কাউকে দেখাতে চান না। এ প্রাপ্তির জল যে তাঁর একান্তই তাঁর।
আর কোনো আক্ষেপের গল্প হয়তো নিয়তির কাছে ছিল না, থাকলেও হয়তো বিরাটের ১৮ বছরের চাওয়ায় হার মেনেছে, হার মানতে বাধ্য হয়েছে। রাজার এবার সব হয়েছে। না, আর কোনো আক্ষেপ নেই, আক্ষেপ থাকা চলে না।
অন্যদিকে, ফুটবলের জাদুকর যার পায়ে থমকে যেত গোটা বিশ্ব, তাঁরও আক্ষেপ ছিল। সবই ছিল তাঁর কাছে। তবে ছিল না একটা বিশ্বজয়ের ট্রফি। ওটা পেলেই তো দুনিয়ার সমস্ত দু:খ অবসরে যেত। সমস্ত প্রার্থনা জুড়ে হয়তো বিধাতার কাছে একটাই চাওয়া ছিল। কথায় আছে মন থেকে যদি কেউ চায় তবেই নাকি পায়। অবশেষে তাঁরও ১৭ বছরের অপেক্ষা ফুরালো।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে, তাঁর চোখেও ছিল একই রকম অশ্রু, একই রকম স্বস্তির নি:শ্বাস। মাঠে বসে থাকা, দুই হাতে মুখ ঢেকে রাখা, আর ভেতরে জমে থাকা আবেগের বিস্ফোরণ— মেসি আর কোহলির দুটি মুহূর্ত যেন একে অন্যের প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এটি কেবল কোহলি কিংবা মেসির গল্প নয়। এটি তাদের ভক্তদের গল্প, যারা বছরের পর বছর ধরে ‘ই সালা কাপ নামদে’ বলে আশায় বুক বাঁধতেন। প্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙলেও, বিশ্বাস হারাননি। আর গত রাত সেই প্রত্যেকটা সমর্থকেরও নিজের করে নেওয়ার রাত।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ বলত, বড় মঞ্চে মেসি পারেন না, আইপিএল জিততে কোহলি অক্ষম। আজ তারা চুপ। কারণ এই দুই কিংবদন্তি তাদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ট্রফিগুলো জিতেছেন স্রেফ ধৈর্য, পরিশ্রম আর একটানা বিশ্বাস দিয়ে।
সব গল্প শেষেই তো সমাপ্তি হয়। তবে যে গল্প বিধাতা সয়ং লেখেন, তাতে অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ জমা হতে হতে ক্লান্ত হওয়া পথিকের শেষ পথটুকু বিধাতা পার করে দেন। ভিন্ন খেলা, ভিন্ন মানুষ তবে দুজনেই যে একই পথে হেটেছেন, শেষটাতে এক বিন্দুতে মিলেছেন। দিনশেষে কী পেয়েছেন এই প্রশ্নটা যখন উঠবে, তখন উত্তরটা হয়তো হবে— চাইতে চাইতে বিধাতাকেও হার মানিয়েছেন।