বিরাটের অনুজ্জ্বল অধ্যায়

সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে ঘিরে ভারতীয় টি-টোয়েন্টি দল থেকে বিরাট কোহলিকে বাদ দেওয়ার গুঞ্জন বেশ ডালপালা মেলেছে। অথচ কয়েক মাস আগেও এমন কিছু ভাবনাতে আসাও অকল্পনীয় ছিল। ভারতের তো বটেই, ক্রিকেট বিশ্বেই সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন তিনি; বিরামহীন রান করেছেন।

বর্তমান প্রজন্মের রান মেশিন খ্যাত বিরাট কোহলি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৫০ এর বেশি ব্যাটিং গড়ে ২৩৬৯৩ রান করেছেন। কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত বেশি গড় নেই, তিনি ইনিংস প্রতি ৪৮.৫২ রান করেছেন। এমনকি সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের মাঝে ৫০ এর বেশি ব্যাটিং গড় আছে শুধুমাত্র কোহলির। 

এছাড়া সেঞ্চুরির হিসেবে বিরাট কোহলি সেরাদের একজন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭০টি সেঞ্চুরি করা বিরাটের সামনে আছে শুধুই ৭১টি শতকের মালিক রিকি পন্টিং এবং শতকের শতক করা শচীন টেন্ডুলকার। কিন্তু বিরাট কোহলি সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেছিলেন ঠিক ২০১৯ সালের নভেম্বরে। এরপর থেকেই তিন অঙ্কের ইনিংসের দেখা পাচ্ছেন এই ডানহাতি।  

লম্বা সময় ধরেই তাই দেখা যাচ্ছে ম্লান কোহলিকে। এখনো যে রান পাচ্ছেন না ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। নিজের অফ ফর্মের সময়েও অন্য অনেক ব্যাটারদের স্বপ্নীল গতিতেই এগুচ্ছেন তিনি। কিন্তু বিরাট কোহলি তো সাধারন কেউ না, নিজেকে বিচার করার মানদণ্ড তো তিনি আগেই অনেক উপরে নিয়ে গিয়েছেন।

আর এজন্যই এই বিরূপ সময়ে একটু বেশিই সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কোহলিকে৷ এছাড়া ভারত জাতীয় দলে কড়া নাড়তে থাকা সম্ভাবনাময়ী তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোহলির দলে জায়গা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

ভারতের সাবেক অধিনায়ক কপিল দেবও ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে বিরাট কোহলিকে দলে জায়গা ছাড়তে বলেছেন। তার মতে কোহলি এখন আর দলে অপরিহার্য নয়। কোহলি এখন নিজের ছায়া হয়ে আছে। অবশ্য বর্তমান অধিনায়ক রোহিত শর্মা নিজের সতীর্থকে সমর্থন করেছেন। এত কিছুর পরেও বিরাট যে এখন ব্যাড প্যাচে আছেন সেটি পরিষ্কার। 

টেস্ট ছিল বিরাট কোহলির সবচেয়ে প্রিয় ফরম্যাট। অথচ এই সাদা পোশাকেই সবচেয়ে বিবর্ণ তিনি। কোহলির রানখরা শুরু হয়েছিল মূলত ২০২০ সাল থেকে, বাংলাদেশ বিপক্ষে সিরিজের পর থেকে। ২০২০ সালে লাল বলে ছয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছিলেন বিরাট।

এ সময় মাত্র ১৯.৩৩ গড়ে ব্যাটিং করেছিলেন। এরপর থেকে শুধু যে সেঞ্চুরি পাননি ব্যাপারটি তেমন নয়, রান করার গতিও ধীর হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৮৪ টেস্ট খেলা বিরাটের পরিসংখ্যান ছিল এমন – ৭২০২ রান, ৫৪.৯৭ ব্যাটিং গড়, ২৭টি সেঞ্চুরি এবং ২৮টি ফিফটি।

অথচ ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ টেস্ট খেলে বিরাট মাত্র ৮৭২ রান করেছে, যেখানে ব্যাটিং গড় ২৭.২৫ আর হাফসেঞ্চুরি ছয়টি। এবং এরই কারনে তার পুরো ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। লম্বা সময় পরে টেস্টে বিরাট কোহলির ব্যাটিং এভারেজ নেমে এসেছে পঞ্চাশের নিচে। 

অন্যদিকে ওয়ানডে ফরম্যাটে শচীন টেন্ডুলকারের অবিশ্বাস্য রেকর্ড ভাঙ্গার দৌড়ে বেশ এগিয়ে ছিলেন বিরাট কোহলি। কিন্তু এখন সেইসব রেকর্ড ছোঁয়া অসম্ভব মনে হচ্ছে তার জন্য। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৬০ এর কাছাকাছি ব্যাটিং গড়ে ১১৬০৯ রান করেছিলেন।

অবশ্য টেস্টের মত এই ফরম্যাটেও পতন শুরু হয়েছে তার। ২০২০ সাল থেকে ৩৯ গড়ে ব্যাটিং করে ৭০২ রান করেছেন তিনি। অন্য ব্যাটসম্যানের জন্য হয়তো ৩৯ অনেক বেশি কিছু, কিন্তু বিরাটের জন্য সেটিই বেমানান। 

ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে আবার তুলনামূলক ফর্মে আছেন বিরাট কোহলি। ২০২০ সালের পর থেকে ৪২.১৮ গড় এবং ১৩৬ স্ট্রাইক রেটে ৬৭৫ রান করেছেন। এমন সংখ্যা আপনার কাছে বিশেষ মনে হতে পারে কিন্তু ২০১৯ সালে বিরাটের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে চিন্তার ভাঁজ পড়বে কপালে। 

২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন দিল্লির ছেলে। ৫২.৬৬ ব্যাটিং গড়ে তিনি ২৬৩৩ রান করেছিলেন, কোন শতক না পেলেও করেছিলেন ২৪ টি অর্ধশতক।

কিংবদন্তিদের ক্যারিয়ারে অফ ফর্ম নতুন কিছু নয়। শচীন কিংবা রাহুল দ্রাবিড়দের ক্যারিয়ারেও রয়েছে রানখরার নজির। কিন্তু সে-সময়ের তুলনায় ভারতীয় ক্রিকেটে এখন অনেক বেশি প্রতিযোগিতা তাই চাপটাও বেশি কোহলির উপর।

তারপরও তিনি কোহলি, রান করতে জানেন। জানেন প্রতিপক্ষের বোলিং লাইনআপকে ধুমড়ে মুচড়ে দিতে। একটা বড় ইনিংস, একটা কার্যকর ইনিংস হয়তো আবারো ফিরিয়ে আনবে পুরোনো সেই বিরাটকে। ফিরিয়ে আনবে বাইশগজে হেলমেট খুলে শতক উদযাপন করা কোহলির পুরোনো ছবিটাকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link