স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে আমরা সর্বোত্তম পর্বে না দেখলেও ১৯৮৩, ১৯৮৭-৮৮ পর্বে ভারতে খেলতে দেখেছি। ভারতে কেমন খেলেছিলেন ভিভ তা নিয়ে একটা ছবি তুলে ধরা যেতে পারে।
- ১৯৭৪-৭৫ সিরিজ
ভারতের মাটিতেই ভিভ তার ক্রিকেট জীবন শুরু করেন ১৯৭৪ সালের সিরিজে।
স্পিন কোয়াট্রেট চন্দ্র শেখর, বিষাণ সিং বেদি, এরাপল্লি প্রসন্ন ও ভেঙ্কটের তখন স্বর্ণযুগ। ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩-২ ফলে সিরিজ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ভিভ প্রথম টেস্ট ব্যাঙ্গালোরে চন্দ্রাহত হয়ে ৪ ও ৩ রানে সাজঘরে ফেরেন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় হয়।
চন্দ্র পরের টেস্টে খেলেন নি। কিন্তু পরের টেস্টে ভিভের স্ট্রোক প্লের ক্যালিপসো ঝঙ্কারে বেদি, প্রসন্ন, ভেঙ্কটের স্পিন মায়াজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এমনভাবে ভিভ বাউন্ডারিতে বল পাঠাচ্ছিলেন যেন বাউন্ডারি সীমানা করমর্দনের দূরত্বে। ভিভ বলতে যে দ্বিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের গরিমা তাঁর ব্যাট নামক শাসনদণ্ডে বাহিত হয়ে এসেছে তা বুঝলেন দর্শককুল।
১৯২* এলো তড়িৎ গতির রানপ্রপাত নিয়ে। ২০ টি চার আর ৬ টি ছক্কায় সাজানো সে ইনিংস ভারতের মাটিতে স্পিনের বিরুদ্ধে রিচার্ডস কেমন খেলোয়াড় তা বুঝিয়ে দিয়েছিলো। দর্শক চিনলেন আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডসকে। আবারও জিতলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পরের টেস্টে আবার চন্দ্র নামক ভেল্কিবাজ স্পিনার দলে ফিরলেন বটে কিন্তু ভিভকে আর চন্দ্রাহত করা যায় নি। বরং ইডেনে ১৫ রানে রানআউট হলেন মুহূর্তের ভুলে। দ্বিতীয় ইনিংসে মদনের রোষে ভস্ম হলেন ভিভ। তবে তার মাঝে ৯ টি বাউণ্ডারীতে ৪৭ রানের ক্ষুদ্র ইনিংস তিনি খেলে ফেলেছেন। এটাই ছিলো দ্বিতীয় ইনিংসে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। যা হোক, ওয়েষ্টইণ্ডিজের পরাজয় হলো।
পরের টেস্টে মাদ্রাজে প্রসন্নর অফ স্পিনের ঘূর্ণিপাকে ৫০ রানে ফিরলেন ভিভ। তাতেও ৭ টি চারের মার ছিলো। দলের সর্বোচ্চ রানও তাঁর। পরের ইনিংসেও এলো মাত্র ২। এবারও প্রসন্নর শিকার তিনি। ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে ছয়- সাতের দশকের অন্যতম সেরা অফস্পিনার প্রসন্ন ভারতকে জয় এনে দিলেন।
পরের টেস্ট বোম্বাইয়ে লয়েড দ্বিশত আর ফ্রেডারিক্স শতরানের এর দাপটে ওয়েষ্টইণ্ডিজের পাহাড়প্রমাণ রানে ভারত হারলো। এবার চন্দ্রের শিকার হলেন ভিভ। মাত্র ১ রানে ফিরলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৩৯* রান করেছিলেন ভিভ। দ্রুত খেলেন ডিক্লেয়ারের জন্য। আটটি চারের সাহায্যে এ রান তোলেন তিনি।
তিনি এ সিরিজে তিনবার চন্দ্র, দুবার প্রসন্ন ও একবার মদনলালের শিকার হন।
ভিভ প্রথম সিরিজে ৫ টেস্টে ৩৫৩ রান করেন ৫০ গড়ে। চার স্পিন কিংবদন্তীর বিরুদ্ধে স্পিনার নির্ভর ভারতে খুব খারাপ
কি ?
- ১৯৮৩ -৮৪ সিরিজ
ভিভ আবার ভারতে আসেন ১৯৮৩ সালে। মজার ব্যাপার হলো এবার স্পিনার নয় ভিভ বিপদে পড়েন অনন্য ফর্মে থাকা কপিলের বিরুদ্ধে। সে সিরিজে ২৯ উইকেট নিয়েছিলেন কপিল দেব। এ সিরিজে তাঁকে চারবার কপিল দেব ও একবার রজার বিনি আউট করেন। যিনি ফাস্ট বা মিডিয়াম পেসারদের যম তাঁকে এবার বিব্রত করেন সেই পেসাররাই।
যদিও এবারও একটি শতরান ও একটি অর্ধশতরান তিনি করেন তবুও তাঁর প্রদর্শন আশানুরূপ ছিলো না।
রিচার্ডস মানে যতক্ষণ তিনি ক্রিজে থাকবেন শাসনদণ্ড তাঁর হাতে থাকবে। সে রকম ছোটো ইনিংস এ সফরে তাঁর ছিলো। যেমন – প্রথম টেস্টে ২৪ রানে কপিলের বলে আউট হন। তাতে ছিলো পাঁচটি বাউন্ডারি।
দ্বিতীয় টেস্টে ৭০ বলে ৬৮ রান করে আবার কপিলের শিকার হন। এবার ৮ টি বাউন্ডারি ও একটি ওভার বাউন্ডারি ছিলো তাঁর ইনিংসে।
চতুর্থ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ১৫ টি বাউন্ডারি ও একটি ওভার বাউন্ডারিতে সাজানো ঝলমলে ১২০ রানের ইনিংস খেলে যান। এ টেস্টে দুবারই তিনি শাস্ত্রীর শিকার।
কপিল ছাড়াও একবার বিনি তাঁকে আউট করেন অল্প রানে। দুই স্পিনার রবি শাস্ত্রী তিনবার ও মনিন্দর সিং একবার তাঁকে আউট করেন। শাস্ত্রী নামজাদা স্পিনার না হলেও ভিভকে বিব্রত করেছিলেন বলা যায়।
এবার ৩৪.২৫ গড়ে ৫ টেস্টে মাত্র ২৭৪ রান করেন তিনি। যদিও মার্শাল, হোল্ডিং সহ পেস ব্যাটারীর দাপটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৩-০ সিরিজ জিততে বেগ পেতে হয় নি। সাথে ছিলো অধিনায়ক লয়েড, গর্ডন গ্রিনিজের ব্যাটের বিক্রম।
- ১৯৮৭-৮৮ সিরিজ
এ সিরিজে অধিনায়ক ভিভের এক দায়িত্বশীল শত রানে পেস সহায়ক দিল্লীর পিচে জিতলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এক অতুলনীয় শতরানের ইনিংস দেখেছিলাম দূরদর্শন পর্দায়। ১০৯ রানের এক পরিশীলিত ইনিংস এসেছিলো। ১১১ বলে ১৩ টি বাউন্ডারির সাহায্যে এক অনন্য ইনিংস তিনি খেলে যান। প্রথম ইনিংসে পেসার চেতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। পুরো দল কপিল চেতনের দাপটে কম রানে গুটিয়ে যায়। (১৪৫)
কলকাতায় একটি ৬৮ রানের ইনিংস খেললেও ভিভ ভাঙা মাদ্রাজ পিচে হিরওয়ানির গুগলিতে বোল্ড হন ৬৮ রানে। যদিও তাঁর ইনিংস ও ভাঙা পিচে যথেষ্ট ভালো ইনিংস। নরেন্দ্র হিরওয়ানি ছাড়াও ঘরোয়া ক্রিকেটের নামী অভিজ্ঞ অফ স্পিনার আয়ুব ছিলেন বিপক্ষে। (আন্ডার প্রিপেয়ার্ড উইকেট) তবুও কিং রিচার্ডসসুলভ ইনিংস তাকে বলা যায় না। ১০২ বলে ৮ টি চারের সাহায্যে এ রান করেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার মাত্র ৪ রানে হিরওয়ানির শিকার হন। দলও পরাজিত হয়।
সে সিরিজে ৪৯.১৭ গড়ে চার টেস্টে ২৯৫ রান করেন রিচার্ডস। ফলে, এখানে তিনি একেবারে ব্যর্থ নয়। আবার রিচার্ডসসুলভও নয়। এবারে তাঁকে দুবার আউট করেন চেতন, একবার মনিন্দর, দুবার হিরওয়ানি।
- ভারতে রিচার্ডসের মোট টেস্ট পরিসংখ্যান
টেস্ট – ১৫
ইনিংস – ২৪,
নট আউট – ৩,
রান – ৯৫৪
ব্যাটিং গড় – ৪৫.৪২
শতরান – তিনটি,
অর্ধ শতরান – চারটি
সর্বোচ্চ – ১৯২ অপরাজিত
- শেষ কথা
তাহলে যা দাঁড়ালো ভারতের পিচে ভিভ রিচার্ডসকে চারবার আউট করেন কপিল, দু’বার চেতন শর্মা, একবার বিনি, একবার মদনলাল। স্পিনারদের মধ্যে তিনবার শাস্ত্রী, দু’বার মনিন্দার, দু’বার হিরওয়ানি তিন বার চন্দ্রশেখর, ২ বার প্রসন্ন আউট করেন।
তাহলে, এখানে পেস ও স্পিনের অনুপাত – ৮ : ১২!
ভিভের ভারতে খারাপ রেকর্ডের আসল কারণ কিন্তু ১৯৮৩ সিরিজ। অন্য দুই সিরিজে তাঁর প্রদর্শন একেবারে খারাপ নয়। শাস্ত্রী আর চূড়ান্ত ফর্মে থাকা কপিল দেবের কারণে ১৯৮৩ সিরিজে তাঁকে বেশ কয়েকবার কম রানে সাজঘরে ফিরতে হয় আর পরিসংখ্যানও খারাপ হয়ে যায়। অথচ শাস্ত্রীকে বিরাট মাপের স্পিনার হিসাবে কেউই গুরুত্ব দেন না। কোথায় ভিভ আর কোথায় শাস্ত্রী।
পরিসংখ্যান এরকম অনেক হিসাব উল্টোপাল্টা করে দেয়। তাই পরিসংখ্যানে সব সময় ভরসা রাখা সঠিক নয়। আরও একটা বিষয় হলো স্যার ভিভ রিচার্ডসকে পরিসংখ্যানে মাপতে যাওয়া বিরাট ভুল। কারণ তাঁর মানসিকতা। যতক্ষণ তিনি ক্রিজে থাকবেন তিনি রাজ করবেন। কালিপসো সুরমূর্ছনায় মোহিত করে রাখবেন দর্শকচিত্ত। খুঁটে রান সংগ্রহ করতে তিনি রাজী ছিলেন না। ভারতেও এটাই তিনি করে গিয়েছিলেন আর সে কারণে আমরা যারা ভিভকে খেলতে দেখেছি তারা পরিসংখ্যানে ভিভকে মাপার ভুল করতে রাজি নই।