ইমরান খান পাকিস্তান ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তি। তাঁকে বোলিং প্রান্তে দেখলে রীতিমত পা কাঁপত প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। সেই ইমরান খানের দুই চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের আরও দুই কিংবদন্তি পেস বোলার। তাঁরা হলেন ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস। ওয়াকার ইউনুসকে তো খোদ ইমরান নিজেই খুঁজে এনে হাজির করেছিলেন বিশ্বমঞ্চে। এই দুই মহারথীর ক্রিকেটীয় লড়াই উপভোগের একেবারে চূড়ান্ত বিষয় হয়ে উঠেছিল সেই ৮০-৯০ দশকে।
একই দলে থেকেও তাঁদের মধ্যে যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তা হয়ত এ যুগের কিশোর-তরুণ শুনেছেন বাবা-কাকাদের মুখ থেকে। হয়ত কেউ কেউ অন্তর্জাল ঘুরে ঘুরে দেখে নিয়েছেন তাঁদের বোলিং। এই দুইজনের খ্যাতি সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বের ছড়িয়ে পড়েছিলো। পড়বেই বা না কেন বলুন! এই দুই বোলার সম্মিলিতভাবে ৮০৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। নিয়েছেন ১৭০৭টি উইকেট। কল্পনা করুণ তো, ঠিক কি পরিমাণ বিধ্বংসী হলে ১৭০৭টি উইকেট নেওয়া যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
ভাবতে থাকুন। তবে আমি একটু পরিসংখ্যান ঘেঁটে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি যে তাঁরা ঠিক কি পরিমাণ বিধ্বংসী ছিলেন নিজেদের স্বর্ণালী দিনগুলোতে। এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীনতম ফরম্যাট টেস্ট ক্রিকেট।সামগ্রিক পরিসংখ্যানই আগে নিয়ে আসি।
ওয়াকার ইউনুসের জাতীয় দলের অভিষেক হওয়ার বছর চারেক আগে ওয়াসিম এসেছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। যেহেতু তাঁদের দুই জনের ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটেছিলো একই দিনে। সে ভিন্ন এক গল্প। সে গল্পে আজ না যাওয়াই ভাল।
ওয়াসিম পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ১০৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। এর মধ্যে তিনি নিয়েছিলেন ৪১৪ উইকেট। তাঁর গড় ছিল ২৩.৬। অদ্ভুতভাবে ওয়াকার ইউনুসের গড়ও ঠিক একই রকম ছিল। ২৩.৬। তবে তিনি ম্যাচ খেলেছিলেন ৮৭টি। যার বিপরীতে তিনি উইকেট নিয়েছিলেন ৩৭৩টি। তবে স্ট্রাইক রেট বিবেচনায় ঢের এগিয়ে ছিলেন ওয়াকার ইউনুস। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের স্ট্রাইক রেট ছিল ৫৫ অন্যদিকে ওয়াকারের স্ট্রাইক রেট ৪৮। আবার আরও এক দিকে মিল রয়েছে এই দুই বোলারের। সেটা হলো ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। সমান পাঁচবার করেই এই দুইজন নিয়েছিলেন ম্যাচে ১০টি করে উইকেট।
বেশ হাড্ডা-হাড্ডি একটা লড়াই যে তাঁদের মধ্যে ছিল তা বোধহয় আর বোঝার খুব একটা বাকি থাকে না। তবে এই দুইজনের লড়াইটা পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝার একমাত্র উপায় একই ম্যাচে এই দুইজনের উপস্থিতি। বাইশ গজে লাল বলে এই দুইজন আগুন ঝড়িয়েছেন একত্রে মিলে ৬১ ম্যাচে। সেখানে ওয়াসিমের উইকেট সংখ্যা ২৮২টি। আর ওয়াকার নিয়েছিলেন ২৭৭টি উইকেট। বুদ্ধিদীপ্ত বোলার ওয়াসিম তাঁর ভ্যারিয়েশনের জোড়ে সব সময়ই উইকেট শিকারে থেকেছেন এগিয়ে। ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়া কিংবা ম্যাচে দশ উইকেট পাওয়া এসব দিক থেকেও এগিয়ে থাকবেন ওয়াসিম।
প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে কি ওয়াকার কি কোন ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিলেন না? ছিলেন মশাই ছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটের মূল কাজটাই হচ্ছে প্রতিপক্ষের ২০টি উইকেট যতদ্রুত তুলে নেওয়া। কেবল তখনই আসবে জয়। পাকিস্তানের জয়ে ওয়াকার সর্বদাই একটু বাড়তি অবদান রেখেছেন নিজের ক্যারিয়ারে আদ্যোপান্ত।
ওয়াকার পাকিস্তানের ৩৯টি টেস্ট জয়ের সঙ্গী হয়েছিলেন। অপরদিকে ওয়াসিমের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৪১। কিন্তু ম্যাচ জয়ে অবদান সবচেয়ে বেশি রেখেছেন ওয়াকার। পাঁচবার ম্যাচে দশ বা তাঁর বেশি উইকেট নিয়েছেন ওয়াকার। এর মধ্যে চারটি ম্যাচই জিতেছিলো পাকিস্তান। ওয়াসিম সেদিক থেকে খানিক পিছিয়ে। মাত্র দুই দফা তাঁর নেওয়া দশ বা ততোধিক উইকেট কাজে এসেছিলো পাকিস্তানের টেস্ট ম্যাচ জয়ে।
শুধু তাই নয়। দুইটি কম টেস্ট ম্যাচের পরিসংখ্যান থাকার পরও ওয়াকারের উইকেট সংখ্যা ওয়াসিমের থেকে বেশি। ওয়াসিম যেখানে ৪১টি জয়ী ম্যাচে নিয়েছিলেন ২১১টি উইকেট। সেখানে ওয়াকার ৩৯টি ম্যাচে নিয়েছেন ২২২টি। সুতরাং জয়ে বন্দরে নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের তরীর দক্ষ নাবিক হিসেবে ওয়াকার ইউনুস বিবেচিত হতেই পারেন। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে।
এই দুইজনের মধ্যে জাতীয় দলের প্রথম দিকে ছিল গলায় গলায় ভাব। তাঁদের মধ্যে হওয়া স্বাস্থ্যকর লড়াইয়ে উপকৃত হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু আফসোস নিজেদের মধ্যকার ইগো নামক অনুভূতিটা দমন করতে পারেননি দু’জনের কেউ।
ফলাফল সম্পর্কে ফাঁটল, কথা কাটাকাটি। শেষমেশ দু’জনকে বাধ্য করা হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াতে। নয়ত আরও কিছুদিন টু ডব্লিউ খ্যাত এই পেস বোলিং জুঁটি কাবু করতো বিশ্ব ক্রিকেটকে। তাঁদের বোলিংয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তো মহাদেশ থেকে মহাদেশে। সাত সমুদ্রে এপার ওপারে।