ষাটের দশকের শেষভাগে তখন ক্রিকেট বিশ্বের সেরা উইকেটরক্ষক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন ইংলিশ উইকেটরক্ষক ব্যাটার অ্যালান নট। ধারাভাষ্যকার, তখনকার ক্রিকেটার সহ সমর্থকদের অনেকাংশের মতে, নটই তখন ছিলেন সেরাদের শীর্ষে। তবে অ্যালান নট অবশ্য এটি মানতেন না! কারণ নটের মতে, সে সময়ের সেরা উইকেটরক্ষক ছিলেন পাকিস্তানি তারকা ওয়াসিম বারি! হ্যাঁ, এই ওয়াসিম বারিকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষকদের একজন। তর্ক-সাপেক্ষে অনেকে এশিয়ার সেরাদের সেরাও মানেন বারিকে!
৮১ টেস্টে ২০১ ক্যাচ আর ২৭ স্টাম্পিং করেছেন ওয়াসিম বারি; যা কিনা টেস্ট পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে মঈন খান, রশিদ লতিফ, কামরান আকমলদের চেয়ে বেশ এগিয়ে। ৩৬ বছর বয়সে যখন বারি অবসর নেন তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ টেস্ট খেলুড়ে ক্রিকেটার!
উইকেটের পেছনে বেশ ধূর্ত স্বভাবের হলেও ব্যাট হাতে ছিলেন একেবারেই সাদামাটা। তখনকার অনেক বোলারও ব্যাট হাতে তাঁর চেয়ে ভালো ইনিংস খেলতে পারতেন! লোয়ার অর্ডারেই ব্যাট করতেন বারি! এমন কি ব্যাটিংয়ে হতশ্রী পারফরম্যান্সের কারণে শেষ ব্যাটার হিসেবেও খেলেছেন তিনি! ইনিংস প্রতি মাত্র ১৫.৮৮ গড়ই বারির হতাশাজনক ব্যাটিংয়ের প্রমাণ!
গ্লাভস হাতে বেশ পারদর্শী হলেও মূলত ব্যাটিংয়ের কারণেই যেন অনেকটা পিছিয়ে গেছেন বারি। উইকেটের পেছনে কঠিন ক্যাচও সহজেই লুফে নিতেন তিনি। কিপার হিসেবে দিতেন বিচক্ষণতার পরিচয়। তবে ব্যাট হাতে কখনোই নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি সাবেক এই পাকিস্তানি তারকা। যার কারণে স্রেফ উইকেটকিপিং দক্ষতার বলেই তিনি ছিলেন একাদশের নিয়মিত মুখ!
যদিও উইকেটকিপার হিসেবে ইয়ান হিলি কিংবা অ্যালান নটের মতো প্রতিভাবান ছিলেন না বারি। তবে নিজের ইউনিক টেকনিকের উপর নির্ভর করেই লুফে নিয়েছেন একের পর এক ক্যাচ! ড্রাইভ দিয়ে ক্যাচ লুফে নিতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না তিনি। তারপরেও অনেক কঠিন ক্যাচকেই সহজে নিজের টেকনিক দিয়ে তালুবন্দি করেছেন এই উইকেটকিপার। উইকেটকিপার হিসেবে ছিলেন আর পাঁচ জনের মতোই সাধারণ। তবে বারির ক্যাচ ধরার কৌশল তাঁকে আলাদা করেছিল বাকি সবার চেয়ে!
১৯৬৭ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন বারি। ওই বছরই ইংল্যান্ডে অনূর্ধ্ব-২৫ দল সর্ব প্রথম বারিকে কিপিং করতে দেখে অনেকেই বলেছিল, ‘সে গ্লাভস হাতে অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক।’ তবে প্রথম চার বছরে দলে ছিলেন একেবারেই অনিয়মিত মুখ। সাদামাটা পারফরম্যান্সের কারণে ছিলেন আসা-যাওয়ার মাঝে।
১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথম ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দিয়ে দলে ইতিবাচক প্রভাব দেখান বারি। লিডসে এক টেস্টেই ৮ ক্যাচ শিকার করে রেকর্ড গড়েন তিনি। প্রথম ইনিংসে লুফে নেন পাঁচ ক্যাচ! এরপর সপ্তম উইকেটে ব্যাট করতে নেমে খেলেন ৬৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ওই ৬৩ রানের ইনিংসের পথেই মেইডেন ফিফটিও করেন বারি। বারির ইনিংসেই ৩৪ রানের লিড পায় পাকিস্তান। পরের ইনিংসে ফিল্ডিংয়ে নেমে তিন ক্যাচ শিকার করে এক টেস্টে সর্বোচ্চ ক্যাচ শিকারের তালিকায় জেমস ক্যালি, গিল ল্যাঙ্গলি, ওয়ালি গ্রুট, জিম পার্কস ও ডেনিস লিন্ডসের পাশে নাম লেখান বারি।
এরপর পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে অ্যাডিলেডে ১০৪ রানে তখন ৭ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং শিবির। ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক ইনতিখাব আলমের সাথে ১০৪ রানের দুর্দান্ত জুটি গড়ে দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করেন বারি। পুরো সিরিজেই উইকেটের পেছনে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। সেবার ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সিরিজের পরেই উইকেটকিপার হিসেবে ক্রিকেট বিশ্বে বেশ সুনাম অর্জন করেন বারি।
সত্তর দশকের শুরুর দিকে সাবেক কিংবদন্তি পাকিস্তানি তারকা ইমরান খান বারিকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, ‘তুমি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা এক উইকেটরক্ষক।’ অবশ্য পরবর্তীতে সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার ট্রনি গ্রেগও ইমরান খানেই এই উক্তিকে সমর্থন করে একমত পোষণ করেন। এমন কি তখনকার সেরা উইকেটকিপার হিসেবে পরিচিত অ্যালান নটও মানতেন বারি তাঁর চেয়ে খানিকটা এগিয়ে!
সরফরাজ নওয়াজ ও ইমরান খান ছাড়া ওই সময় পাকিস্তানের কাছে ওয়ার্ল্ডক্লাস পেসার ছিল না বললেই চলে। ইমরান খানের বলে ৩৬টি ক্যাচ ও সরফরাজের বলে ৩৫ টি ক্যাচ নেন বারি! স্পিনারদের বিপক্ষেও দুর্দান্ত কিপিং করতেন তিনি।
পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে টেস্ট অভিষেকের প্রায় ৬ বছর পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন বারি। ১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক টেস্টে চার স্টাম্পিং করেও নতুন রেকর্ড গড়েন তিনি। অষ্টম উইকেটকিপার হিসেবে এক টেস্টে চার স্টাম্পিং করার কীর্তি গড়েন বারি।
এর এক বছর বাদেই ১৯৭৭ সালে ব্রিজটাউনে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন বারি। ব্যাট হাতে তাঁর হতাশাজনক পারফরম্যান্সের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ১১তম ব্যাটার হিসেবে খেলতে নামেন বারি। ১৫৮ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে তখন চরম বিপর্যয়ে পাকিস্তান। শেষ উইকেটে ওয়াসিম রাজার সাথে ১৩৩ রানের অনবদ্য এক জুটির পথে অপরাজিত ৬০ রানের ইনিংস খেলে দলের হাল ধরেন বারি!
অধিনায়ক হিসেবেও বেশ কিছু সময় পাকিস্তান দলের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরবর্তীতে অধিনায়কত্ব থেকে অব্যহতির পরেও উইকেটের পেছনে তিনি ছিলেন নিয়মিত এক মুখ। ১৯৭৮ সালে ভারতের বিপক্ষে লাহোর টেস্টে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নামেন বারি। কপিল দেব, বিষান সিং বেদি, ভগবত চন্দ্রশেখরদের সামনে দুর্দান্ত লড়াইয়ে করে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ৮৫ রানের ইনিংস!
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক টেস্টে প্রথম আট ব্যাটারের সাতটি ক্যাচই শিকার করেন বারি! এর মাধ্যমে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েন এই উইকেটরক্ষক। প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে এক ইনিংসে সাত ক্যাচ ধরার কীর্তি গড়েন বারি।
১৯৮১ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে বারি ছিলেন অনিয়মিত এক মুখ। কালে-ভদ্রে রঙিন জার্সিতে খেলার সুযোগ পেতেন তিনি। ৫১ ওয়ানডের মাঝে ক্যারিয়ারের শেষ তিন বছরেই খেলেন ৩০ ওয়ানডে! ক্যারিয়ারের একদম শেষ মূহুর্তে ১৯৮৩ সালে ব্যাঙ্গালোরে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের বিপদে আবারো হেসে উঠে বারির ব্যাট! ১৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়া পাকিস্তানকে উদ্ধার করেন ৬৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে। এরপর ১৯৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয় বারিকে!
ব্যাট হাতে ডাক মেরেছেন ১৯ বার! পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ ডাকের রেকর্ডেও নাম তুলেছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার! ১১২ ইনিংসে ৬ ফিফটিতে মাত্র ১৩৬৬ রান করেন বারি। অপরদিকে, ৫১ ওয়ানডেতে ১৭ গড়ে করেন মাত্র ২২১ রান! আরেকটি তথ্য হলো বারি ৫১ ওয়ানডেতে ২৬ ইনিংসে ব্যাট করে কখনোই শূন্য রানে আউট হননি!
১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন বারি! পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে প্রধান নির্বাচকেরও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।