দূর থেকে হাত নাড়ছেন মানচিনি

প্রবাদ প্রচলিত – আগে ডিফেন্স, পরে অ্যাটাক। কাউন্টার অ্যাটাকে অভ্যস্ত ইতালি দেশ বরাবর ভাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষকের জন্ম দিয়ে গেছে। ১৯৮২ সালের ব্রাজিল সৌন্দর্য্যকে ছারখার করে দেওয়া কারামুক্ত পাওলো রসি ইতালিতে একটাই জন্মেছিল।

আর পাওয়া যায়নি পরে। অ্যাটাক নির্ভর না খেলে নিয়মিত ডিফেন্স করে পরের পর মাঝমাঠ থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করে অভ্যস্ত ইতালিতে সাজানো বাগান তৈরি করলেন এক ভদ্রলোক। ইতালি শেষবার বিশ্বকাপ পেয়েছিল ২০০৬ সালে। ক্যানাভারো-নেস্তা-দেল পিয়েরো-তোত্তি-পির্লো-বুঁফো-মাতেরাজ্জির দল অস্তাচলে চলে যাওয়া এবং মার্সেলো লিপ্পির মতো তুখোড় ডিফেন্সিভ কোচের অবসর ইতালিকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বেশ খানিকটা পিছিয়ে দেয়।

ফলত, ২০১০ বিশ্বকাপে স্লোভাকিয়ার মতো দেশের কাছে হারে প্রথম রাউণ্ডে ছিটকে যাওয়া এবং ২০১৪ বিশ্বকাপেও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন পর্বেই ছিটকে গেল ইতালি। চারবারের বিশ্বজয়ীদের ছাড়া রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বকাপ!

এমনই এক অস্থির সময়ে, ইতালির ডাগআউটে এসে হাজির হলেন এক উল্টোস্রোতের ভদ্রলোক। যিনি এতদিনের পুরোনো অভ্যাস পাল্টে ইতালি ফুটবলকে দিলেন এক নতুন ঘরানা। অ্যাটাক নির্ভর। পাল্টে দিলেন এতদিনের সাজানো রীতি। ঘোষণা করে দিলেন, ‘ড্র করার থেকে ১-০ তে জেতা আমি বিশেষ পছন্দ করি।’ রবার্তো মানচিনি।

যিনি নিজে ইতালিয় হয়েও পছন্দ করেন না কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল। বরং তার দল খেলতে শুরু করল অ্যাটাক নির্ভর ফুটবল। একে একে তৈরি করতে লাগলেন ছাত্রদের। বাঁদিক থেকে ইনসেগ্নি এবং ডানদিক থেকে বেরার্দি উঠে আসতে লাগল বল নিয়ে। মুহুর্মুহু ক্রস উঠতে লাগল দু’দিক থেকেই। মাঝমাঠে জর্জিনহো হোল্ডিং নির্ভর খেলা তৈরি করতে লাগল।

মাঝমাঠে বহু সংখ্যক পাস এবং সেটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল দুটো উইংয়ে। এমনকি বাঁদিক থেকে লেফটব্যাক স্পিনাজোলা ওভারল্যাপে উঠে আসতে লাগল। নিচে ডিফেন্সের নেতৃত্বে থাকল অভিজ্ঞ চিয়েলিনি এবং বোনুচ্চি। বুঁফোর জায়গায় গোলরক্ষার দায়িত্বে দোনারুমা। দোনারুমার সবথেকে বড় প্লাস পয়েন্ট, গোল ছেড়ে কখন বেরিয়ে আসতে হবে অর্থাৎ টাইমিং জ্ঞান দুরন্ত। ফরোয়ার্ডে ইমমোবাইলও ফিরে পেল তাঁর ফর্ম।

ইতালির রক্ষণভাগ সামলে আর পাল্টা আক্রমণে ওঠার প্রয়োজন রইল না। টানা দু’দিক থেকে আক্রমণে বিরুদ্ধপক্ষ দিশেহারা হতেই একসময় আসতে লাগল গোল। অফেন্সিভ গেম খেলেই ইউরোতে স্থান, সেখানেও টানা তিন ম্যাচ জিতে প্রথম দল হিসেবে রাউণ্ড অফ সিক্সটিনে পৌঁছে যাওয়া। সব মিলিয়ে গত তিরিশটি ম্যাচে মানচিনির দল হারেনি। যার মধ্যে শেষ এগারোটি ম্যাচে একটাও গোল খায়নি।

১৯৯০ বিশ্বকাপ হয়েছিল তাঁর দেশেই। রবার্তো মানচিনি ছিলেন সেই স্কোয়াডে। সুইজারল্যান্ড ম্যাচের পরেই সিদ্ধান্ত নেন ওয়েলশ ম্যাচে গোটা রিজার্ভ বেঞ্চকে খেলাবেন। ফলস্বরূপ, দোনারুমা শুরু থেকে খেললেও পরে তাঁকেও পরিবর্তন করে শিরিগুকে নামানো। মানচিনি নিজে সে বিশ্বকাপে একটিও ম্যাচ খেলেননি, তাই তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ – এই ইউরো কাপের স্কোয়াডে থাকা কোনও খেলোয়াড়কেই তিনি একটিও ম্যাচ না খেলিয়ে ফেরাবেন না।

মানসিনি বরাবর নব যুগের সূচনা করে গেছেন ইতালিতে। সেই ২০১০-১১ সময়ে ম্যানচেস্টার সিটির কোচ থাকাকালীন সমীর নাসরি-তেভেজ-আগুয়েরো-ভিনসেন্ট কোম্পানি-এডিন জেকো-ইয়াইয়া তোরে-পাবলো জাবালেতাদের প্রিমিয়ার লিগের কাপে চুম্বন করিয়েছেন। বস্তুত একবিংশ শতকে ম্যানচেস্টার সিটির নব উত্থান হল মানচিনির হাত ধরেই।

২০০৭-০৮ অবধি পরপর তিনবার ইন্টার মিলানকে সিরি ‘এ’ দিয়েছেন। সব এসেছে এই অফেন্সিভ ছক থেকেই। মানচিনি সুন্দর ফুটবলের পাশাপাশি জেতাকে বরাবর প্রাধান্য দিয়েছেন। দিনের শেষে সাফল্য হিসেবে জয়ই ধার্য হয়। এ রুক্ষ পৃথিবীতে শিল্পের যুগ শেষের পথে। তবু মানসিনি জোসে মোরিনহো না হয়েও জেতার পথ দেখিয়েছেন।

এক যুগ পর সেই মানচিনিই ইতালিতে নবজাগরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। নীলজার্সির আজ্জুরিরা আবার হাসছে। গ্যালারিতে থাকা ইতালিয়ান জনগণ মাথায় লাল-সাদা-সবুজ চুলের বাহার নিয়ে উন্মাদনায় ভাসছে। রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়াম হয়ে সেজে উঠেছে ফুটবল উন্মত্ততায়। দূর থেকে হাত নাড়ছেন রবার্তো মানচিনি। মুখে এক চিলতে হাসির ছোঁয়া। তাঁর কাজ যে এখনও অনেক বাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link