স্বাগত, সাকিব আল হাসান ২.০

২০০৭ সালের কথা।

সাকিব আল হাসান তখনও বাংলার নবাব, বাংলার জান, বিশ্বের এক নম্বর কিংবা হিরো নম্বর ওয়ান হয়ে ওঠেননি। নিতান্ত কৈশোর পার করা সাকিব ২০০৬ সালের বর্ষসেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতেছিলেন প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়া পুরষ্কারের আয়োজনে। আমিও তখন রিপোর্টার হিসেবে হাটি হাটি পা করছি।

তরুন রিপোর্টার হিসেবে আমার দায়িত্ব পড়েছিলো তরুন সাকিবের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া নেওয়ার। আমি গিয়ে মুখস্ত প্রশ্ন করলাম,

‘পুরষ্কার পেয়ে নিশ্চয়ই তৃপ্তি লাগছে?’

তিনি তার ট্রেডমার্ক হাসিটা ঠোটে ঝুলিয়ে, চোয়ালটা একটু শক্ত করে এবং আমাকে থমকে দিয়ে উত্তর দিলেন,

‘নাহ। তৃপ্তি লাগছে না। বরং একটা চাপ টের পাচ্ছি। আগামী বছর আমাকে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হতে হবে। নইলে লোকে এই সেরা উদীয়মানের পুরষ্কারটাকে ফ্লুক মনে করবে।’

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, সাকিব কথাটা রেখেছিলেন। ঠিক কথা রেখেছিলেন বললে কম বলা হয়। এরপর ‘বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ’ খেতাবটাকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিলেন। তাকে টানা এই পুরষ্কার জিততে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালক ও প্রথম আলোর তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র মঞ্চে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে সাকিবকে বিবেচনার বাইরে রেখেই মনে হয় বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচন করতে হবে!’

সাকিব হেসেছিলেন।

সেই হাসিতে কে কী দেখেছিলেন, আমি জানি না। তবে আমি দেখেছিলাম প্রতীজ্ঞাপূরণের এক দৃঢ় হাসি।

এই হলেন সাকিব আল হাসান। তাকে হাজারো শব্দে, হাজারো বিশেষনে বর্ননা করা যায়। কিন্তু দিনশেষে সাকিবের সেরা রূপ হলো, তিনি কথাটা রাখতে জানেন এবং তিনি ঘোষনা দিয়ে ময়দানে নামতে জানেন। তিনি বলে কয়ে মাঠে নামতে পারেন এবং মাঠে ফিরতে পারেন। তিনি কামব্যাক হিরো নম্বর ওয়ান।

আজ সেই কামব্যাক হিরো সাকিব আল হাসানের জীবনের আরেকটা পর্ব শুরু হলো। দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষার পর আজ থেকে সাকিব আল হাসান আবার একজন মুক্ত ক্রিকেটার। একেবারে তুচ্ছ কারণে এক বছর আগে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন সাকিব। এর মধ্যে পদ্মা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সাকিব এই সময়ে নিজেকে নিয়ে মুখ খোলেননি। তবে আমরা দূর থেকে বুঝেছি, প্রতীজ্ঞায় আরও শক্ত হয়ে উঠেছে তার চোয়াল। সেই শক্ত চোয়াল নিয়েই দেশে ফিরে ক্রিকেট শুরু করার অপেক্ষায় আছেন সাকিব; সাকিব আল হাসান ২.০।

সাকিবের কথা রাখার কথা হচ্ছিলো।

এই ধরুন অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফরের আগের কথা। তখন অবধি অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বিশ্বের সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে কমপক্ষে একবার সাকিবের ইনিংসে ৫ উইকেট ছিলো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলার আগে সংবাদ সম্মেলনে কেউ একজন সাকিবকে বললেন, ‘এই দুই টেস্টে একবার অন্তত ৫ উইকেট নিলে রেকর্ডটা হয়ে যাবে।’

সাকিব হেসে বললেন,

‘তাই নাকি? ঠিক আছে। চেষ্টা করবো।’

করলেন। একবার নয়। এক টেস্টের দুই ইনিংসেই ৫ টি করে উইকেট নিলেন এবং দলকে জয় এনে দিলেন।

তারপর ধরুন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালের খুলনা টেস্ট। সেঞ্চুরি করলেন প্রথম ইনিংসে। এই অধম পাশে হাটতে হাটতে বলেছিলো,

‘টেস্টে সেঞ্চুরির সাথে ৫ উইকেট খুব বেশি খেলোয়াড়ের নেই। করবেন নাকি?’

আবার সেই হাসি। একটু পাশ ফিরে বলেছিলেন,

‘দেখি, চেষ্টা করে। হয়ে যাবে।’

পরের ইনিংসেই ৫ উইকেট। বুঝতেই পারছেন, এমন বলে কয়ে রেকর্ড করতে পারা মানুষ দুনিয়ায় রোজ রোজ আসে না।

অনেকে সাকিব আল হাসানকে এই বলে কয়ে পারফরম করতে পারার জন্য ইয়ান বোথামের সাথে মিলিয়ে থাকেন। বোথাম ছিলেন কামব্যাক হিরো।

১৯৮৬ সালের কথা। গঞ্জিকা সেবন করেছিলেন বোথাম। সেই কথা আবার পত্রিকায় নিজের কলামে লিখেও দিয়েছিলেন। ফলে তাকে নিষিদ্ধ করেছিলো ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড।

তিন মাস নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর প্রথম বলেই পেলেন উইকেট। তার বলে ব্রুস এডগারের ক্যাচটা ধরেছিলেন গ্রাহাম গুচ। ক্যাচ ধরে নিজের বিষ্ময় সামলাতে পারেননি গুচ। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার এই স্ক্রিপ্ট কে লিখে দেয়?’

সাকিব আল হাসান ২০১৪ সালে সম্ভবত বোথামকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। সেবার কী এক বিচিত্র কারণে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।

আজও পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞার কারণটা পরিষ্কার না। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে রওনা দিয়েছিলেন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মৌখিক অনুমতি নিয়ে। কথা ছিলো লিখিত অনুমতিটা মেইলে পাঠানো হবে। সেটা তো পাঠানো হলোই না। বরং ‘এনওসি’ না নেওয়ার অপরাধে তাকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। নিশ্চয়ই এটা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত ছিলো।

প্রত্যাবর্তন দিয়েই সাকিব বুঝিয়ে দিলেন যে, কাকে বিসিবি নিষিদ্ধ করে রেখেছিলো।

ফেরার পর প্রথম ইনিংসেই তুলে নিলেন ৫ উইকেট। ওই তিন টেস্টের সিরিজের রেকর্ডের ছড়াছড়ি করলেন। এই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়ে বোথামের পাশে নাম লেখালেন। তিন টেস্টে ২৫১ রান করলেন এবং ১৮টি উইকেট নিলেন। আর ২টি উইকেট নিতে পারলে একক এক অনন্য ক্লাবের মালিক হতেন। এর আগে বিশ্ব কখনো তিন টেস্টের সিরিজে কোনো খেলোয়াড়ের ২৫০ রান এবং ২০ উইকেট দেখেনি। কিন্তু যা করলেন, তাই বিশ্বের বিষ্ময় হয়ে গেলো।

সাকিব আল হাসানকে ‘কামব্যাক কিং’ বলতে তাই আপত্তি থাকার কথা নয়।

এই সাথে তার আরেকটা প্রত্যাবর্তনের কথাও মনে করা যেতে পারে। ২০১৪ সালেই ক্যামেরার সামনে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করায় ৩ ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। ফিরেই প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬ বলে ৪৪ রানের দানবীয় এক ইনিংস খেলেছেন।

বুঝতেই পারছেন, কেনো আমরা সাকিবের দ্বিতীয় ভার্শনের অপেক্ষায় আছি।

এর আগের আঘাতগুলো ছোট ছিলো। তারপরও জবাবগুলো ছিলো দাতভাঙা। এবারের আঘাতটা তার ক্যারিয়ারের বৃহত্তম; এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। তাহলে কী আমরা বৃহত্তম একটা জবাবের অপেক্ষায় থাকবো?

এই প্রশ্নের জবাবটা সময়ের হাতে তোলা থাক। আমরা শুধু জানি, ভেতরে ভেতরে সাকিবের প্রস্তুতির অভাব নেই। ফিটনেস বাড়িয়েছেন অবিশ্বাস্য পরিমানে। মাঝে দেশে এসে বিকেএসপিতে তিন-চার জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে স্কিল ও ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন। এখন স্রেফ মাঠে নেমে নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করে ফেলার পালা।

অবশ্য সাকিব আল হাসানের কী আর নিজেকে প্রমাণের কিছু বাকী আছে? নিশ্চয়ই না। তিনি তো বাংলার নবাব। আমরা তার নবাবীর সাথে আগেই পরিচিত।

এখন বরং আরাম করে, স্বস্তি নিয়ে বসা যাক। আরেকটা নবাবী প্রদর্শনী উপভোগের অপেক্ষায় থাকা যাক।

স্বাগতম, হে বাংলার নবাব।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link