২ জুলাই, ১৯৬৯। এই দিনে তৎকালীন ক্রিকেটের বিপুল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ২৫ রানে অলআউট হয়! চোখ কপালে তুলে দেবার মতো খবরই বটে, তবে বিপক্ষ দলের নাম শুনলে চোখটা মাথাতেও উঠে যেতে পারে! বিপক্ষ দলের নামটি যে আয়ারল্যান্ড! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ‘মাইটি’ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ২৫ রানেই অলআউট করেছিলো আইরিশরা!
বেলফাস্টের বেশ কাছেই অবস্থিত ‘সিওন মিলস’ নামক গ্রামে, সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে আতিথেয়তা দেয় আয়ারল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক নামী তারকাই এই ম্যাচে অংশ নেননি, কিন্তু মাত্র দেড় ঘণ্টায় ২৫ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পথে সেটা কোন কারণ হতে পারে না।
কাগজে কলমে ম্যাচটি অফিশিয়াল মর্যাদা পায়নি এটা ঠিক, তবে এটি ছিল একটি ওয়ানডে ম্যাচ যেখানে উভয় দলই দুই ইনিংস করে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিল। যদি উভয় দলের দুই ইনিংস শেষ না হয়, তাহলে প্রথম ইনিংসে লিড নেয়া দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে এমনটাই চুক্তি ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এটি ছিল শুধুই একটি রিল্যাক্স করার ম্যাচ, কিন্তু আয়ারল্যান্ডের কাছে এটি ছিল প্যাশন এবং সন্মানের।
সদ্যই ইংল্যান্ডের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের টেস্ট খেলে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্লান্তি এক রাতের ঘুমেই বিদায়। ঝকঝকে রোদের সকালে ঘুম ভাঙে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের। যতক্ষনে তারা মাঠে পৌছালো, ততক্ষণে মাঠের সিট সবই প্রায় পরিপূর্ণ। শহরবাসীর জন্য এটি ছিল একটি বিশেষ দিন, ‘হার্ডসম্যান মিল’, যেখানে গ্রামের প্রায় সকল মানুষ কাজ করতো, তারা তাদের মিল ওই দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছিলো। আশেপাশের গ্রামের অতি উৎসাহী মানুষও হাজির হয়েছিলো তারকা সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এক নজর দেখতে।
গ্যারি সোবার্স ম্যাচটি মিস করেন ইনজুরির কারনে, ইংল্যান্ড সফরে পাওয়া চোট তাকে লন্ডনেই রেখে দিয়েছিলো। রয় ফ্রেডারিখ, ল্যান্স গিবস, চার্লি ডেভিসকেও বিশ্রাম দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত খেলোয়াড়, তৎকালীন ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম ম্যানেজার ক্লাইড ওয়ালকটকে সেদিন খেলোয়াড় হিসাবে নামিয়ে দেয়া হয়।
টস হবার আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন বুচার, আয়ারল্যান্ড ক্যাপ্টেন গুডউইনের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগে ব্যাট করার প্রস্তাব রাখেন। গুডউইন রাজি হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওপেনাররা ব্যাট করতে নামে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল এতোটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, তারা খেলার আগে একবারের জন্যও পিচটা দেখারও প্রয়োজন বোধ করেনি। আগের রাতে হয়ে যাওয়া তুমুল বৃষ্টি মাঠের ভেতরই পানি জমিয়ে রেখেছিলো। পিচ ঢাকার কোন বালাই ছিল না সেই সময়ের ক্রিকেটে, বুচার যখন ডাগআউটে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন তার বুট অর্ধেক পরিমান পানিতে ডুবে যাচ্ছিলো।
ব্যাটিং করতে নেমে উইকেট দেখেই প্রমাদ গুনলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনার জো ক্যারিউ এবং স্টিভ কোমাচো! সবুজ ঘাসের পিচ বৃষ্টির জলে চকচক করছে। পিচে আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করতেই পুরোটা আঙুল পিচের ভেতরে প্রবেশ করলো। তারা বুঝলেন, আজকের দিনটি অনেক লম্বা হতে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের জন্য। এই পিচে ব্যাটিং করা একা একা ঘুমিয়ে দেখা দুঃস্বপ্নের মতোই ভয়ংকর!
টাক মাথার মিডিয়াম ফাস্ট বোলার রিওরডান, ক্যাপ্টেন গুডউইন এর সাথে আয়ারল্যান্ডের পক্ষে বোলিংয়ের সূচনা করলেন। তারা তখনও জানতেন না, আজকের দিনটি শুধুই বোলার আর ফিল্ডারদের হতে যাচ্ছে।
দেখতে না দেখতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর গিয়ে দাঁড়ালো ১/২ ! দুই ওপেনারকে ১ রানের ভেতর হারিয়ে পিচে আসলেন ক্যাপ্টেন বুচার। উইকেটে পৌছুতেই তার বুট এবং প্যাড কাঁদায় মাখামাখি অবস্থা। রিওরডানের একটি ন্যাস্টি ডেলিভারি খুব বাজেভাবে তার বাহুতে লাগলো। রান তখন সোনার হরিন, আর তেমনই একটা সোনার হরিণ চুরি করতে গিয়ে ফস্টার রান আউটের শেকলে বন্দী!
যতক্ষণে বিবিসির ক্যামেরাম্যানরা তাদের ক্যামেরা অ্যাডজাস্ট করে নিতে সক্ষম হয়েছে, ততক্ষণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন উইকেট হাওয়া এবং সম্প্রচারের কাজ শুরু হবার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ৬/৪ ! অধিনায়ক বুচার আউট!
গ্রেট ক্লাইভ লয়েড যখন মিডঅনে তালুবন্দি হলেন তখন দলের রান ৬/৫। উইকেটের থেকে রান বেশি করাই তখন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় ম্যানেজার কাম প্লেয়ার ক্লাইড ওয়ালকট ক্রিজে আসলেন, যদিও তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো না যে, তাকে নামিয়ে দেয়াতে তিনি আদৌ খুশি হয়েছেন!
কার থেকে কে আগে আউট হবে এহেন প্রতিযোগিতার ভিড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান দুই অংকে পৌঁছে গেলো, কিন্তু উইকেট ততক্ষনে ৯ টা লাপাত্তা! ১২/৯, এই যখন অবস্থা তখনই হয়ে গেলো এক বিশ্বরেকর্ড! শেষ উইকেট জুটিতে দলের রান ডাবল করে ফেললেন শেষ দুই ব্যাটসম্যান। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্লেয়ার যখন আউট হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ তখন মাত্র ২৫ রান!
২৫.৩ ওভারেই সব শেষ, মাত্র দুজন বোলারই বল করার সুযোগ পেয়েছে, অন্যরা নিজেদেরকে অভাগা ভাবতেই পারে!
১২৫/৮ এই স্কোর নিয়ে আয়ারল্যান্ড যখন ইনিংস ঘোষণা করে, দিনের খেলা তখনও এক ঘণ্টার মতো বাকী। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দিন শেষ করে ৭৮/৪ স্কোর নিয়ে। কিন্তু প্রথম ইনিংসে লিড নেবার কারনে আয়ারল্যান্ডকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। জ্যামাইকার করেস্পন্ডেন্ট এলডি গ্লিনারস তার নোটে লিখেন, ‘খেলা চলাকালীন সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকা সদর্পে উড়ছিল, কিন্তু এটা অর্ধনমিত থাকলেই ভালো দেখাত।’
গ্রাম্য গুজবে বলা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দেরকে এমন কিছু খাওয়ানো হয়েছিলো যে, তারা মাঠে গিয়ে দাঁড়াতেই পারেনি, যদিও এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
এখনকার দিনে এমন কিছু ঘটলে হয়তো, ফিক্সিংয়ের গন্ধ খোঁজা শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু ৫০ বছর আগের এই ম্যাচটিকে দেখা হয়েছিলো বিপর্যয় হিসেবেই। সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে খবর পরিবেশন করা বেশিরভাগ পত্রিকাই জানত না এই ‘সিওন মিলস’ জায়গাটা আসলে ঠিক কোথায়!
অজানা জায়গায়, সৌখিন এক দলের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের এই বিপর্যয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে বড় আপসেট হিসেবেই দেখা হয় এখন পর্যন্ত!