ম্যারাডোনা নাকি পুসকাস হবেন মেসি?

স্বপ্ন সারথি কিংবা পুরো একটা প্রজন্মকে ফুটবলে মাতিয়ে রাখা এক জাদুকর। সবুজ ঘাসে তিনি বুলিয়েছেন তুলির আঁচড়। দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে ফুটবলটাকে নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছেন লিওনেল মেসি। রেকর্ড বইয়ে যার নিয়মিত আনাগোনা। কতশত রেকর্ডে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। ঠিক যেমন তাঁর আধিপত্য ভক্তদের মনে। আরও একটিবার তিনি অমরত্ব পাওয়ার ঠিক দ্বারপ্রান্তে। দূরত্বটা কেবল নব্বইটা মিনিটের।

খানিকটা হোঁচট খেয়ে শুরু। তবুও তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। নিজের দলটাকে রীতিমত একাই টেনে নিয়ে আসলেন ফাইনাল অবধি। আরও একটিবার ল্যাতিন আমেরিকার দেশটি বিশ্বকাপ স্বপ্ন জয়ের ক্ষণ গননা শুরু করে দিয়েছে। লিওনেল মেসি যে সর্বকালের সেরাদের একজন সে নিয়ে কারও মনে সন্দেহ থাকবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তবে বিশ্বকাপ জয়ের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে মেসির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাগ্য।

২০১৪ সালে লিওনেল মেসি দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনাল অবধি ঠিক এবারের মত করেই। একহাত দুরত্ব থেকে তিনি সোনালী ট্রফিকে শুধুই দেখেছিলেন, পরম আদুরে স্পর্শে আলিঙ্গন করতে পারেননি। বছর আটেক বাদে আরও একবার লিওনেল মেসির সামনে সুযোগ প্রায় ছয় কিলোর সেই ট্রফিটা উচিয়ে ধরবার। তিনি কি পারবেন, ১৯৮৬ সালের স্বদেশী ম্যারাডোনা হতে, নাকি তিনি বনে যাবেন ১৯৫৪ সালের অভাগা ফেরেঙ্ক পুসকাস।

ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা ফেরেঙ্ক পুসকাস, এই দুই মহাতারকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। প্রায় তিন দশকের ব্যবধান। তবে তাঁরা দুইজনই নিজেদের সময়ে রাজত্ব করেছেন গোটা ফুটবল বিশ্বে। লিওনেল মেসির মত করেই তাঁরাও ফুটবলকে ভালবাসতে বাধ্য করেছেন। তাদের সুনিপুণ দক্ষতায় মন্ত্রমুগ্ধের মত করে আটকে রাখতেন দর্শকদের। ফুটবলের এই যে বিশ্বায়ন আর এত উন্মত্ততা এসব কিছুর বিস্তারে পুসকাস আর ম্যারাডোনার কৃতিত্ব অস্বীকার করবার উপায় নেই।

১৯৮৬ বিশ্বকাপটা তো রীতিমত একা হাতেই জিতিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। দলের প্রাণভোমড়া ছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনা দলটাকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন আনন্দের চরম শিখরে। ব্যক্তিগত জীবন ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৬ এর কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলটা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও তিনিও ফুটবল মাঠে জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে গেছেন। বদৌলতে ফুটবল দেবতা তাঁর হাত রাঙিয়ে দিয়েছেন সোনালী মোড়কে। তবে ফেরেঙ্ক পুসকাসের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তার উল্টোটা।

হাঙ্গেরি দলটা ১৯৫৪ বিশ্বকাপের শুরুতে রীতিমত তাণ্ডব করেছে। প্রতিপক্ষের গোলবার দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছিল তাঁরা প্রথম রাউন্ডে। আর সে তাণ্ডবের পেছন থেকে অবদান রেখেছিলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস। চারটি গোল করার পাশাপাশি তিনি দলের পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যার ফলে ফাইনালে হারার পরও তাঁর হাতে উঠেছিল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার, গোল্ডেন বল। ম্যারাডোনাও ঠিক একই রকমভাবে প্রভাব বিস্তার করে খেলেছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। তিনিও জিতেছিলেন গোল্ডেন বল।

ঠিক তাদের মত করেই আর্জেন্টিনার এবারের দলের প্রাণভোমরা লিওনেল মেসি। তিনি দলের পক্ষে এবার পাঁচটি গোল করেছেন। তাছাড়া তিনটি গোল করিয়েছেন সতীর্থদের দিয়ে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মলিনাকে দিয়ে করানো গোল কিংবা সেমিফাইনালে আলভারেজকে বাড়ানো বলটা নিয়ে আলাদা একটা কাব্য রচনা করা যায়।

এই কাজটা ২০১৪ সালেও করেছিলেন মেসি। সেবার তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল গোল্ডেন বল। তবে এবার তিনি ব্যক্তিগত অর্জনের উর্ধ্বে যেতে চাইবেন নি:সন্দেহে। এটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। এটাই শেষ সুযোগ। এবারের দলটাও বেশ সংঘবদ্ধ। দলের পেছনের মাস্টারমাইন্ড লিওনেল স্কালোনিওই দারুণ ট্যাকটেশিয়ান।

অতএব, মেসির জন্য মঞ্চটা তৈরি। এবার শুধু ভাগ্য দেবতার সুপ্রসন্ন হবার অপেক্ষা। গোল্ডেন বল অথবা গোল্ডেন বুট, যে কোন একটা মেসি জিততে চলেছেন সেটা নিশ্চিত। কিন্তু মেসি কি হবেন ম্যারাডোনা নাকি পুসকাস? সময়ের কাছে তোলা থাক সে প্রশ্নের উত্তর। ফুটবলের এই সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকার শেষ বেলায় খালি হাতে ফিরে যাওয়াটা হবে বড্ড বেদনাদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link