কেন আমরা আরেকজন সাকিব পাই না!

আমরা কেন সাকিব আল হাসানের পর অন্য কোনো অলরাউন্ডার খুঁজে পাইনি জানেন? কারণ, আমরা সব সময় আরেকজন সাকিবকে খুঁজি।

তর্কসাপেক্ষে সাকিব একটা বড় সময় যাবৎ সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে একাধারে সেরা স্পিনার ও সেরা ব্যাটার ছিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটে আপনি এমন খেলোয়াড় খুঁজেই পাবেন না! কারণ বেশিরভাগ অলরাউন্ডারের বোলিং বা ব্যাটিং একটা সাইড শক্তিশালী থাকে,যার উপর নির্ভর করে তিনি দলে আসেন। পরবর্তীতে অনেকেই সময়ের সাথে অন্য রোলটায় উন্নতি করেন।

আপনি মানুন বা না মানুন, সাকিব আমাদের দীর্ঘকাল সেই অপশনটা দিয়েছে, যাতে আমরা বাড়তি ব্যাটার বা বোলার খেলাতে পারি। দু:খের বিষয়, আমাদের মতোন ক্রিকেট দল ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ পাওয়ার মতো এমন সম্পদ হাতে পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে পারিনি, সাকিবকে দলে পাওয়ার মতোন আশীর্বাদ পেয়েও দল গঠনে আরও আগ্রাসী হতে পারিনি, সাহস দেখাতে পারি নি। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে।

সাকিবের বদলি হিসেবে না হোক, দলের প্রয়োজনে একজন অলরাউন্ডারকে থিতু হতে না দেওয়ার দায় দেশের ক্রিকেট সিস্টেম বা খেলোয়াড়দের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি সেকেলে রক্ষণাত্মক চিন্তায় ঘিরে থাকা বোর্ডের।

আমরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার খুঁজে হাহাকার করি, তাই না? অন্তত চোখের সামনেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে দু’জন পেস বোলিং অলরাউন্ডারকে তাদের পিক টাইমে জাতীয় দলের রাডার থেকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কেবল নির্বাচকদের পরিকল্পনাহীনতার কারণে।

এখানে ফরহাদ রেজা ও জিয়াউর রহমানের নামে আসতে বাধ্য। ফরহাদ রেজা লঙ্গার ভার্সনে সহজেই পঞ্চম বোলিং অপশন হিসেবে বিবেচিত হতে পারতেন। আর রেজা, জিয়া দু’জনই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাত নম্বরে কার্যকরী সম্পদ হতে পারতেন।

অনেকে বলবেন, সুযোগ পেয়েছে তাঁরা। কিন্তু আসলে তারা যথেষ্ট সুযোগ পাননি। জিয়াউর রহমানের পিক টাইমে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেরা বিগ হিটার। আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট টি-টোয়েন্টিতে তাকে নামাতেন এক-দুই ওভার বাকি থাকা অবস্থায়, বা শেষ ওভারে।

এই পজিশনে সুযোগ পেয়ে ব্যাট করে আসলেই কি খুব বেশি ধারাবাহিক হওয়া সম্ভব? এখন একই সমস্যা হচ্ছে শামিম পাটোয়ারির সাথে। জিয়া তাঁর সেরা সময় পেরিয়ে গেছেন তবু এখনও তার হিটিং অ্যাবিলিটি অনেক খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি।

আর ফরহাদ রেজার কপাল যারপরনাই খারাপ। তিনি এমনই এক খেলোয়াড়, যিনি এমন ম্যাচে টি-টোয়েন্টি দলে সু্যোগ পেতেন, যে ম্যাচে প্রায় সবাই-ই ব্যর্থ হতো, দল বাজেভাবে হারতো, তার হাতে শেষ ওভারের বল তুলে দেওয়া হতো আর সমর্থকদের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়তো রেজার উপর। ফলাফল,বাজে খেলেও অন্য ফরম্যাটের পারফরম্যান্স দিয়ে মহারথীরা ম্যাচের পর ম্যাচ, বছরের পর বছর খেলে গেলেও ফরহাদ রেজা পরের ম্যাচেই বাদ।

অথচ, তাদের বদলে কোন পেস বোলিং অলরাউন্ডার সুযোগ পান নি, পেয়েছেন বাড়তি ব্যাটার বা কখনও স্পিনার। যদিও পজিশন অনুযায়ী খেলোয়াড় বাছাই করতে হয়। অথচ বছরখানেক আগেও বিপিএলে রেজার ইম্প্যাক্টফুল পারফরম্যান্স ছিল, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ম্যাচও জিতিয়েছেন।

আর টেস্ট ক্রিকেটে পেস বোলিং অলরাউন্ডারের হাপিত্যেশ করা ম্যানেজমেন্ট ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফরমার ফরহাদের উপর ভরসা করতে পারেনি, খেলিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কখনওবা মোহাম্মদ মিঠুন বা সাব্বির রহমানদের।

আসলে তারা হাপিত্যেশ করতেই ভালোবাসেন, আরেকটা সাকিব নেই বলে বলে তারা একটা স্পিন অলরাউন্ডারকেও সুযোগ দেন না, বিশেষ করে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত আর খুব সম্প্রতি শুভাগত হোমের কথা অবশ্যই বলা দরকার, যিনি জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন,অথচ সাকিবের অনুপস্থিতিতে ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা স্পিন অলরাউন্ডার বিবেচিত হন না। কারণ, তিনি, সাকিবের মানের না!

অথচ নিউজিল্যান্ড কলিন ডি গ্রান্ডহোম, জিমি নিশাম বা ড্যারেল মিশেলদের ঠিকই ব্যবহার করে। অস্ট্রেলিয়া মিশেল মার্শ, ক্যামেরুন গ্রিনদের ব্যবহার করে, ভারত হার্দিক পান্ডিয়া,ভেঙ্কটেশ আইয়ারদের ব্যবহার করে। পাকিস্তানের ফাহিম আশরাফ, দক্ষিণ আফ্রিকার ফেহলুকওয়াওরাও সাকিব আল হাসান বা বেন স্টোকস মানের নয়। ভারতের রবীন্দ্র জাদেজা বা রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের নাম না-ই বা নিলাম।

আসলে ‘আমাদের মত দল’ এটা এফোর্ড করতে পারে না,ও টা করতে পারে না, সেটা করতে পারে না – এই মানসিকতাই আমাদের এগোতে দেয় না। আমরা ছোট দল-এই মানসিকতা নিয়ে বাড়তি সাহস না দেখায়েও আপনি নিজের গা বাঁচাতে পারছেন?

ফ্ল্যাট ট্রাকেও তো আফগান, জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে টেস্টে হারতে হয়েছে। টি-টোয়েন্টির কথা না হয় বাদই দিলাম। একজন লেগ স্পিনার, পেস বা স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার তৈরির জন্য একটি জায়গায় এক্সপেরিমেন্ট-এর সাহস দেখালে যা খারাপ রেজাল্ট পাচ্ছি,এর চেয়ে আর কতো ই বা খারাপ হতো!

আসলে ‘আমাদের মত দল’ বলে বলে নিজেদের মধ্যে যে হীনমন্যতার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন, তা দিয়ে আসলে কোনোদিন বড় কিছু করা দূরে থাক, সামনে এগোনো যায় না। এজন্যই আবারও না চাইতেও ‘ব্যাড বয়’-এর কথাটাই বলতে হচ্ছে, ‘সবার আগে এই দলের মানসিকতা বদলানো দরকার।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link