উপন্যাসের উচ্ছ্বসিত উপসংহার

সেই শক্তিতেই নিজ হাতে লিখে ফেললেন কাব্য। সর্বশেষ ম্যাচে গোল না পাওয়া রোনালদো কতটা ভয়ংকর তার আরো এক নিদর্শন যেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড বিশ্বের সম্মুখে উপস্থাপন করলো। নিজের সবচেয়ে ভয়ংকরতম রূপে মাঠে নেমেই ম্যাচের মাত্র সাত মিনিটের সময় ডি বক্সের ভেতরে সতীর্থ অ্যান্টনি ইলাঙ্গা’র বাড়ানো বল জালে জড়িয়ে উল্লাসে মাতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বাদ, লিগের পয়েন্ট টেবিলেও নেই খুব একটা ভাল অবস্থান; সবমিলিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কারোই সময়টা ভাল যাচ্ছিলো না। বিশেষ করে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যেন সমালোচনা আর বিদ্রুপের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন।

রোনালদো তো কম করেননি। সিরি ‘এ’ ছেড়ে ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক লিগে ফিরেছিলেন৷ কিংবদন্তি হওয়ার শুরুটা যেখানে, কিংবদন্তি হয়ে সেখানেই ফিরেছিলেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে ৫ ম্যাচে ৬ গোল করে একা হাতেই দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন নক আউট পর্বে। যদিও সেখানে থেমে গিয়েছিল যাত্রা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেও দলের হয়ে সর্ব্বোচ্চ গোলস্কোরার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ক্লাবের প্লেয়ার অব দ্য মান্থ-ও হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার।

কিন্তু যারে দেখতে নাহি পারি তার চলন বাঁকা। প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নড়বড়ে অবস্থান যেন রোনালদোকে ট্রল করার সবচেয়ে বড় অস্ত্রতে পরিনত হয়। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোল করা সত্ত্বেও তাকে বানানো হয় দলের বোঝা! সমালোচনার তূণে বারবার বিদ্ধ হলেন রোনালদো।

যতবারই নিন্দুকের নিন্দে কানে এসেছে ততবারই নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। নরওয়ে সিটি’র বিপক্ষে যখন মাঠে নেমেছিলেন তখন একরাশ দুশ্চিন্তা ছিল, হয়তো ছিল নিজেকে উজাড় করে দেয়ার তীব্র মানসিক শক্তি।

সেই শক্তিতেই নিজ হাতে লিখে ফেললেন কাব্য। সর্বশেষ ম্যাচে গোল না পাওয়া রোনালদো কতটা ভয়ংকর তার আরো এক নিদর্শন যেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড বিশ্বের সম্মুখে উপস্থাপন করলো। নিজের সবচেয়ে ভয়ংকরতম রূপে মাঠে নেমেই ম্যাচের মাত্র সাত মিনিটের সময় ডি বক্সের ভেতরে সতীর্থ অ্যান্টনি ইলাঙ্গা’র বাড়ানো বল জালে জড়িয়ে উল্লাসে মাতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

ম্যাচের বয়স যখন ৩২ মিনিট তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পেয়েছিল কর্নার আর অ্যালেক্স টেলেসের ভাসানো কর্নার কিকে মাথা ছুঁয়ে দলকে দ্বিতীয় গোল এনে দেন পর্তুগিজ যুবরাজ।

রেড ডেভিল ভক্তরা যখন মেতেছিল উল্লাসে তখনই দলের উপর ভর করে পুরোনো এক রোগ। হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে যায় ইউনাইটেডের ডিফেন্স লাইন। বিরতিতে যাওয়ার ঠিক আগে গোল করেন নরওয়ে’র মিডফিল্ডার কাইরান ডোয়েল এবং বিরতি থেকে পরার একটু পরে আরো এক গোল করে দলকে সমতায় আনেন নরওয়ে’র অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার টিমু পুক্কি।

তবে ম্যাচের নাটকীয়তার বাকি ছিল তখনও। দুই গোলের লিড নিয়েও জিততে না পারার দুঃখ সহ্য করতে যখন প্রস্তুতি নিয়েছিল ভক্তরা তখনই আবার দৃশ্যপটে আসেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ম্যাচের ৭৬ মিনিটে ফ্রি-কিক পেয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

না, ফ্রি-কিক থেকে নেওয়া ক্রসে গোল করেননি রোনালদো। বরং শট নিতে এগিয়ে এসেছিলেন নিজেই। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে শট নিয়ে সরাসরি পরাস্ত করেন নরওয়ে গোলরক্ষক ক্রুলকে। নিজেকে উজাড় করে দেয়ার প্রচন্ড মানসিক দৃঢ়তার জোরেই হয়তো ২০১৯ সালের পর থেকে এই প্রথম সরাসরি ফ্রি কিকে গোল পেলেন রোনালদো।

ফিনিশড’ আখ্যা পাওয়া রোনালদো হ্যাটট্রিক করেছেন, জিতিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। প্রিমিয়ার লিগে এবারের আসরের সর্বোচ্চ গোল দাতার তালিকায় দিয়েগো জোতা’র সঙ্গে যৌথভাবে উঠে এসেছেন তিন নম্বরে। দুইজনই এবারের লীগে করেছেন ১৫টি গোল। সবমিলিয়ে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ক্লাবের হয়ে রোনালদো গোল করেছেন ২১টি। তাতেই টানা ১৬ মৌসুমে বিশের অধিক গোল করার রেকর্ড গড়েছেন সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

প্রিমিয়ার লিগে পুনরায় ফিরে আসার পরে এটি রোনালদোর দ্বিতীয় হ্যাট্রিক। তবে এর আগে ২০০৮ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রথম প্রিমিয়ার লিগ হ্যাটট্রিক করেছিলেন আর ২০২২ সালের ২রা মার্চে টটেনহ্যামের বিপক্ষে তুলে নিয়েছিলেন নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। এর ঠিক এক মাস তিনদিন পর রেড ডেভিলদের হয়ে তৃতীয় হ্যাটট্রিক করলেন রোনালদো। ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৬০টি হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি যার ৫০টি ক্লাবের হয়ে বাকি ১০টি এসেছে জাতীয় দল পর্তুগালের জার্সি গায়ে।

নরওয়ে’র বিপক্ষে হ্যাটট্রিক কিংবা টটেনহ্যামের বিপক্ষে; দুটি হ্যাটট্রিকের জন্যই এমন এক সময় বেছে নিলেন রোনালদো যখন তাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। সর্বকালের সেরা হওয়ার এইতো বৈশিষ্ট্য; দলের প্রয়োজনে সবার আগে।

রোনালদোর বুটজোড়া অবশ্য সময়ের সাথে সাথে পুরোনো হয়ে গিয়েছে। তবু বুটজোড়া রোনালদোর, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। মাঠে নামা মাত্রই জীবন্ত হয়ে পড়ে তারা। বয়সের বাঁধা ডিঙিয়ে বলকে সজোরে আছড়ে ফেলতে চায় গোল লাইনের ওপাশে। দুমড়ে মুচড়ে দিতে চায় প্রতিপক্ষকে। তবু ইচ্ছের বিরুদ্ধে থমকে দাঁড়াতে হয়, বয়সটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন বয়সের অংকের এক জটিল সমীকরন মেলাতে বসতে হয়।

কিন্তু যেদিন সমীকরণ সমাধান করা হয়, সেদিন এমন অতিমানব হয়ে উঠেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। রোনালদোর এমন পারফরম্যান্স শুধু নিন্দুকের জন্যই যন্ত্রনাময় নয়, ভক্তদের জন্যও অদ্ভুত। যতটা মুগ্ধ করেছে, ততটাই জ্বালা সৃষ্টি করেছে হৃদয়ে। অনেকটা ফাঁসির আগে কয়েদীর মনের অবস্থার মতই; যে জেনে ফেলেছে পৃথিবীর এসমস্ত দৃশ্য ঠাঁই পাবে তার শেষ দেখার তালিকায়। রোনালদোও যে এখন শেষের পথেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...