ক্রিকেট – শুধু একটি খেলা নয়। এর সাথে মিশে আছে আবেগ। আবেগ বললেও ভুল হবে। এটি জীবনের একটি অংশ। হয়ত খাবার ছাড়াও একটা দিন পার করে দেয়া যাবে। কিন্তু ক্রিকেট সম্পর্কীয় কোন কিছু ছাড়া হয়ত একটা ঘণ্টাও পারি দিতে কষ্ট হয়ে যাবে।
উপরের কথাগুলো আমাদের দেশের একজন সাধারণ ক্রিকেট প্রেমীর সাথে মিলে যায়। শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারত পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কা এই সব দেশের মানুষের সাথেই এই কথাগুলো মিলে যায়। উপমহাদেশের মানুষের জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে ক্রিকেট। যেন ক্রিকেটই জীবন।
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে হিসেব করলে ক্রিকেট হল বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা। দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা হলেও আমাদের উপমহাদেশে আর অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিছু দ্বীপদেশ বাদে বাইরের দেশে ক্রিকেট নিয়ে তেমন কোন সাড়াশব্দ নেই। এই যে দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা এটা মূলত উপমহাদেশের ১৭০ কোটি মানুষের বদৌলতে। উপমহাদেশ বাদে বহিবিশ্বে ক্রিকেট আমেরিকান ফুটবল বা রাগবির চেয়েও কম জনপ্রিয়।
ক্রিকেট যে বর্হিবিশ্বে জনপ্রিয় নয় এর পিছনে যদি কারণ অনুসন্ধান করা হয় তাহলে প্রথমেই বলতে হবে এই খেলা খেলার সময় অনেক বেশি। যেদিকে একটা ফুটবল ম্যাচ শেষ হয় ৯০ মিনিটে, হকি ম্যাচ ৭০ মিনিটে। অন্যান্য খেলার সময়সীমাও এর মধ্যে। সেখানে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফর্মেটও শেষ হতে ৩ ঘন্টার চেয়ে বেশি লেগে যায়। তাছাড়া এর বিভিন্ন নিয়মের মারপ্যাচতো আছেই। সাথে আরও যোগ করতে হবে খেলাটা অনেক ব্যয়বহুল। সব মিলিয়ে বলা যায় এসব কারণেই ক্রিকেট তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি।
পুরো বিশ্বের বিপরীত অবস্থা আমাদের উপমহাদেশে। আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ জন খুব অল্পতেই ধৈর্য্য হারা হয়ে যায়। সাধারণত আমরা তেমন আইনকানুন মানতে চাই না। তার উপরে ক্রিকেট হল ইংরেজ তথা ব্রিটিশদের খেলা। ব্রিটিশরা যখন এই উপমহাদেশে শাসন করত তখন তাদের প্রতি আমাদের মনোভাব ছিল বিদ্বেষ পূর্ণ। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, শাসনব্যবস্থা এখানকার স্থানীয়রা খুব সহজে মেনে নিতো না। তারপরও ক্রিকেট কেন এত জনপ্রিয় আমাদের এই উপমহাদেশে?
সেই কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।
১.
ব্রিটিশদের মধ্যে যারা এদেশ শাসনের জন্য আসত, তারাই মূলত প্রথম দিকে এদেশে ক্রিকেট খেলা শুরু করে। তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করা আমাদের দেশীয় রাজা বা শাসকরা ক্রিকেট খেলা আরম্ভ করে। যেমন – আমাদের দেশে সর্বপ্রথম কোন ক্রিকেট খেলা হয় নাটোরের রাজার মাধ্যমে। তেমনি অন্য সব অঞ্চলেও ঠিক একইভাবে দেশীয়দের মধ্যে খেলার প্রচলন হয়।
সাধারণ মানুষ সেই সব রাজাদের থেকে অনুপ্রাণিত হন। এখনও দেখা যায় আমরা সবাই অনুকরণপ্রিয়। বিশেষ করে যারা সমাজে কোন বেঞ্চমার্ক করে দেয় তাদেরকে। রাজাদের খেলা দেখে তা অনুকরণ করে সাধারণ মানুষও তা খেলতে অনুপ্রাণিত হয় তা বলাই যায়। তাছাড়া, ক্রিকেট ছিল অনেকটা দেশী খেলা ডাংগুলির মত। তাই মানুষও খুব সহজে তা বশ করে নেয়।
ওই সময় আরেকটা ব্যাপার কাজ করতো, ভারতবর্ষের দলগুলো যখন ব্রিটিশ কোনো দলকে হারাতো তখন দর্শকরা রাজনৈতিক ভাবে খুব উদ্বুদ্ধ হত। তাই তো এই অঞ্চলের ক্রিকেটের সাথে জাতীয়তাবাদ মিলে মিশে একাকার হয়েছে।
২.
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ফুটবলও এই উপমহাদেশে অনেক জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু জনপ্রিয়তা থাকার পরও ফুটবলে তেমন কোন বড় সাফল্য ছিল না। অন্যদিকে ক্রিকেটে খুব সহজেই সাফল্য পাওয়া যেত। ১৯৮৩ সালে যদি ভারত বিশ্বকাপ না জিততো তাহলে বলাই যায় ক্রিকেট তাদের দেশে এখনকার মত তেমন জনপ্রিয় হতে পারত না। ঠিক এমনটাই বাংলাদেশের বেলায়ও বলা যায়।
১৯৯৭ সালে যদিনা বাংলাদেশ দল আইসিসি ট্রফি না জিতত বা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই না করত তাহলে ক্রিকেটের এত প্যাশন এই বঙ্গদেশে আসত না। ঠিক এমনটাই শ্রীলঙ্কা দলের জন্য। যদিনা তারা ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ না জিততো তাহলে তাদের দেশেও ক্রিকেট এক নম্বর খেলা হত না। অন্য দিকে পাকিস্তানে এই রকম নিয়ামক ছিল ইমরান খান। তার জনপ্রিয়তার কারণে ক্রিকেটের হাইপও অনেক বেড়ে যায়।
তাই বলাই যায় উপমহাদেশের দেশগুলো ফুটবলে তেমন সফল না হওয়া এবং ক্রিকেটে সাফল্যের কারণেই ক্রিকেট এখানে বেশী জনপ্রিয়।
আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, ফুটবলের বিপরীতে হকি কেন নয়? কারণ হকিতেও ভারত, পাকিস্তানে অনেক সাফল্য আছে!
হকিতে সাফল্য থাকলেও, হকি খেলাটা সাধারণ মানুষের জন্য দিবাস্বপ্ন। কারণ হল, হকি খেলতে অবশ্যই বড় মাঠ লাগবে। সাথে সবার জন্য লাগবে একটি করে স্টিক। আর অপর দিকে ক্রিকেট ব্যাট না থাকলেও উপমহাদেশের মানুষ কোন কাঠের টুকরো বা অন্য ব্যাটের মত কিছু দিয়ে আরেকটি বল দিয়েই খেলা যায়। হকি থেকে যা অনেক সহজলভ্য। এসব কারণে হকিকে পিছনে ফেলে ক্রিকেট হয়ে যায় বেশী জনপ্রিয়। তাছাড়া হকি খেলায় ফিটনেস লাগে অনেক, সেখানে ক্রিকেটে তুলনামূলক কম ফিটনেস নিয়েও খেলা যায়।
ক্রিকেট কেন এই অঞ্চলে এত জনপ্রিয়? – তার আরও অনেক কারণ দেয়া যাবে। কিন্তু ঠিক কতটুকু জনপ্রিয় তা বলে শেষ করা যাবে না। ইংলিশ ক্লাবগুলোর ফ্যানরা যেমন তাদের দলের প্রতি অনেক প্যাশনেট। যদি প্যাশন মাপার যন্ত্র থাকত তাহলে দেখা যেত ক্রিকেট নিয়ে আমরা আরও বেশী প্যাশনেট।