আমরা কেন হারি!

এক

যেকোন টেস্ট হারের পরে সকলে হারের কারণ খুঁজে বের করতে থাকে, ম্যাচে বা সিরিজের ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত হয়- যাতে কোন কোন সময়ে অযুহাত খুঁজে দাঁড় করানো হয়, কখনো বা অমুক তমুক প্লেয়ার, ক্যাপ্টেন, কোচ- প্রমুখের উপরে দোষ চাপানো হয়। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডি জের মত দুর্বল, আনকোড়া দলের সাথে হারলে বা ভালো দলের বিরুদ্ধে বা প্রতিকূল সিচুয়েশনে (বিদেশের মাটিতে) গো-হারা হারলে হতাশাটা বেশি থাকে, ফলে রিয়্যাকশনটাও সেরকম হয়! কিন্তু, এইসব ময়নাতদন্তে বেশিরভাগ সময়েই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা উঠে আসে না বা আড়ালেই থেকে যায়!

সেটা হচ্ছে, আমাদের টেস্ট খেলার সামর্থ্য কতটুকু, টেস্ট খেলার মাইন্ড সেট আপ কতখানি তৈরি করা গিয়েছে বা আমাদের খেলোয়াড়রা টেস্ট খেলার মত উপযোগী বা প্রস্তুত কতখানি! এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো আড়ালে থেকে যায় বা রাখা হয়, কেননা এই প্রশ্নগুলোর সাথে সাথেই চলে আসে দায়-দায়িত্বের প্রশ্নটি! এত বছর পরেও আমাদের প্রোপার টেস্ট খেলার সামর্থ্য তৈরি যে হলো না, মাইণ্ড সেটাপই যে নাই, অপ্রস্তুত খেলোয়াড়দের দিয়ে টেস্ট খেলতে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে- সেটার দায় আসলে কার, কিংবা এসবের মূল কারণ যে কি – এগুলো আর খুজতে যাচ্ছি না! ফলে, ‘আশানুরূপ’ ফলাফলই আমরা পাচ্ছি!

দুই

ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপ্টেন মুমিনুল তাৎক্ষনিক ময়নাতদন্তে জানিয়েছে, টেস্ট হারার দায় দুইটাঃ ৫০% দায় টসে হারার আর ৫০% দায় হচ্ছে ১ম ইনিংসে ২৫০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার। আমি ক্যাপ্টেনের কথার সাথে একমত যে, এই টেস্টের এমন ফলের প্রধান দুইটা কারণ হচ্ছে এই দুইটা, যদিও পার্সেন্টেজের পরিমাণ কমে যাবে এবং অন্যান্য কারণ সেখানে যুক্ত হবে। টসে হারার কারণে বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনা ৫০% (বা তারও বেশি) কমে গেছে বলা যেতে পারে, কিন্তু সেটা হারার সম্ভাবনা বড়জোর ১০% করতে পারে, কেননা টসে হারার পরেও শ্রীলঙ্কার এরকম অনভিজ্ঞ বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ড্র করার সম্ভাবনাটা বিশাল ছিল।

তবে হ্যাঁ, প্রথম ইনিংসের এমন ব্যাটিং অনেক বড় কারণ, ড্র-ও করতে না পারার। এই বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে ১ম ইনিংসটা ৩য় দিন পার করে ৪র্থ দিনেরও এক-দুই সেশন পর্যন্ত নিতে না পারা বিশাল ব্যর্থতা, যেটি আসলে আমাদের হারকে নিশ্চিত করেছে!

তিন

শুধু ম্যাচের দিকে যদি তাকাই, এই দুই কারণের বাইরেও বেশ কিছু কারণ আছে, যেমন –

ক্যাচ মিস, বিশেষ করে শ্রীলংকার প্রথম ইনিংসে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ-হাফক্যাচগুলো মিস না করলে, পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো! আগে ভাগে অল আউট করা সম্ভবও হতে পারতো, রান কম হতো, তার চাইতেও বড় কথা বাংলাদেশ আরো আগে ব্যাটিং এ নামতে পারতো (যখন উইকেট ফ্লাট ছিল) …

তৃতীয় দিন, বিশেষ করে চতুর্থ দিনে উইকেটের সুবিধা পাওয়ার পরেও স্পিনার দুজন সেভাবে সেটাকে কাজে লাগাতে পারেনি! স্পিনারদের ভ্যারিয়েশনের ও মাথার অভাব! সেই সাথে ডিফেন্সিভ ফিল্ডিং সেটিং – (আগেভাগে) শ্রীলঙ্কাকে অল-আউট করতে বা কম রানে বেঁধে ফেলতে না পারার কারণ!

চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং! ম্যাচ বাঁচানোর চেস্টা কারোর মধ্যেই সেভাবে ছিল না। এই টিটুয়েন্টির যুগে ম্যাচ বাঁচানো টেস্ট ইনিংস কিভাবে খেলতে সেটাই যেন সবাই ভুলে গিয়েছি! ফলে, অনেককেই সাফাই গাইতে দেখেছি, এমন উইকেটে ড্র করার চেস্টা করলে আরো অনেক কম রানে প্যাকেট হয়ে আরো বড় লজ্জার হার আমরা পাইতাম। তার চাইতে এইরকম মেরে ধরে খেলাই ভালো হয়েছে!

এমন কথা যারা বলছেন, তাদেরকে বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয় যে, টেস্ট ক্রিকেটে সাঈফের মত ছক্কা মারতে গিয়ে বল উপরে তুলে দেয়া বা মুশির মত ঐরকম পরিস্থিতিতে রিভার্স সুইপ, স্কুপ এইসব খেলে দ্রুত রান তুলে দ্রুত আউট হয়ে যাওয়াটাই অনেক লজ্জার, তার চাইতে বরং রান কম তুলে বা না তুলে হলেও অসংখ্য বল খেলে একটা খুব ভালো বা আনপ্লেয়েবল বলে আউট হয়ে যাওয়াটা বেশি সম্মানের, টপ অর্ডারের একটা ব্যাটারও সাত নম্বরে নামা ব্যাটারের চাইতে বেশি বল খেলতে পারলো না- এইটাই অনেক বেশি লজ্জার!

চার

ম্যাচের একটু পেছনে যদি যাওয়া যায়, তাহলে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাওয়া যাবে!

একাদশে সাদমানের বদলে সাঈফ হাসানকে খেলানোর কারণ হিসেবে টিম ম্যানেজমেন্টের বরাতে যা পড়েছি সেগুলো হচ্ছে – টপ অর্ডারে ডান হাতি – বাহাতি কম্বিনেশন আনা (হাস্যকর কারণ, কেননা এটা অপরিহার্য কোন শর্ত নয়), সাঈফ এনসিএল এর দুই ম্যাচেই রানের মধ্যে ছিল, যেখানে সাদমান ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১ম টেস্টের পরে ইনজুরির কারণে দীর্ঘদিন ম্যাচ প্রাক্টিসের অভাবে ছিল (এটাও হাস্যকর কারণ- কেননা পরীক্ষিত ব্যাটার যে সর্বশেষ টেস্টেই ফিফটি করেছে, ইনজুরি থেকে ফেরার পরে আবার একাদশে ঢুকে যাবে- এটাই কাম্য!)। তবে, এইসব কারণের চাইতেও আমার মতে সাদমানকে বাদ দিয়ে সাঈফকে নেয়ার সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে- টেস্টের একাদশে সাদমানের টাইপের বা মাপের ব্যাটারের গুরুত্ব আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট আজতক অনুধাবন করতে পারে নাই!

দ্বিতীয় টেস্টে একাদশে তিন পেসার অন্তর্ভুক্তি। প্রথম টেস্টের ঘাসের উইকেটটাই ছিল একেবারে ফ্লাট। সেখানে পেস ধরবে এই আশায় তিন পেসার খেলানোর সিদ্ধান্ত ছিল ইতিবাচক। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে ন্যাড়া উইকেট দেখেও একইভাবে তিন পেসার খেলানোটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। উইকেট দেখে সকলেই বলছিলো চতুর্থ-পঞ্চম দিন উইকেট ভাঙবে। উইকেটে পেসারদের জন্যে কিছু থাকবে না, স্পিনাররাই মূল কাজ করবে।

এরকম অবস্থায় ২ পেসার নিয়ে, আরো একজন ব্যাটার (ইয়াসির রাব্বি বা সোহান) বাড়ানো যেত, কিংবা আরেকজন স্পিনার (নাঈম) যুক্ত করা যেত! কিন্তু উইকেট দেখার পরেও ৩ পেসার খেলানো হয়েছে। এমনকি ৩ পেসার, ২ স্পিনার নিয়ে খেলার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও এবাদতকে না খেলিয়ে রাহীকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা ছিল ভুল!

বস্তুত একাদশে নাঈম হাসান বা সোহানকে নেয়ার কোন ব্যবস্থা বা উপায়ই রাখে নাই আমাদের নান্নু-বাশারের নির্বাচক কমিটি। ২১ জন খেলোয়াড়ই কিন্তু শ্রীলংকায় অবস্থান করছিলো, অথচ নির্বাচকরা দুইবারই স্কোয়াড দিয়েছে ১৫ জনের। ক্যাপ্টেন আশা করেছিলো- ১৭ জনের স্কোয়াড হবে! ক্যাপ্টেন দেশ ছাড়ার আগে বলেছিলো- ভালো উইকেট কিপার চায়! অথচ, ২১ জন থেকে ১৫ জনের স্কোয়াড বানানোর সময়ে সবার আগে ৩য় স্পিনার নাঈম হাসান আর আমাদের নাম্বার ওয়ান কিপার সোহানকে বাদ দিয়েছে। এর কারণ কি? কারো জানা নেই!

পাঁচ

এই যে নানান কারণ এখানে আলোচনা করা হলো- এসবই আসলে সারফেসের কারণ, মানে উপরে উপরে কারণ। এসবের পেছনের কারণগুলো আসলে খুঁজে বের করতে হবে, যদি সত্যিকারের টেস্ট প্লেয়িং দেশ হতে চাই। না হলে, এভাবে জোড়াতালির টেস্ট খেলার আসলে কোন মানেই হয় না! ফলে, সেরকম কয়েকটা পয়েন্টের দিকেই দৃষ্টি দেয়া যাক। মোটাদাগে তিনটা সমস্যা আমি দেখি –

  • টেস্ট খেলার অ্যাবিলিটিতেই ঘাটতি

আমাদের সত্যিকারের উইকেট টেকিং বোলার নাই। পেসার নাই, স্পিনারও নাই- যাদের মাধ্যমে উইকেটের মারাত্মক সহায়তা বাদে কোন দলের ২০ উইকেট নেয়ার কথা চিন্তা করতে পারবো। টেস্ট টেম্পারমেন্ট ওয়ালা সলিড একটা ব্যাটার নাই, যে ১ম দিনে উইকেটে কিছুটা মুভমেন্ট বাউন্স থাকলে কিংবা ৩য়-৪র্থ-৫ম দিনে কিছুটা স্পিন ধরলেই- মুড়ি, মুড়কির মত ধ্বসে পড়বে না আমাদের ইনিংস! এই ধ্বসের জন্যে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যাণ্ডের বোলিং দরকার হবে না- জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের সি টিম-ই এনাফ।

  • মাইন্ড সেটাপে সমস্যা

যাদেরও বা কিছুটা এবিলিটি ছিল বা আছে, তাদের সমস্যা মাথায়! ধরেন, আমাদের সবচাইতে টেকনিক্যালি সাউণ্ড, সবচাইতে পরিশ্রমী, সবচাইতে ডেডিকেটেড ব্যাটার হচ্ছে মুশফিক! কিন্তু, কিপিংটা আকড়ে ধরে দলের বিশাল ক্ষতি করেছে সে বছরের পর বছর, তার মাপের ব্যাটার ৪ নাম্বারে ব্যাট করতে ভয় পায় বিধায় ৬ নাম্বারে খেলে- ফলে যেখানে এতদিনে ৬-সাড়ে ৬ হাজার রান পার হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ৭৪ টেস্টে এখনো ৫ হাজারই করতে পারে নাই, গড় মাত্র ৩৭, যার পেছনে আবার মরা উইকেটে জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করা দুটো ডাবল হান্ড্রেডের ভূমিকা।

মাথার সমস্যাটা আরো ভালো বুঝা যাবে এই টেস্টেই তার শট সিলেকশন দেখে! শুধু মুশফিক কেন, সবচাইতে প্রতিভাবান হিসেবে খ্যাত লিটন যেভাবে ম্যাচের পর ম্যাচ উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসে- তার পেছনে এবিলিটির ঘাটতি যতখানি, তার চাইতেও তো সমস্যা মাথাতে! এই মাথার সমস্যাটা দূর হবে কিভাবে? বা এর কারণই কি? আমি তো এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে একটা প্রোপার টেস্ট ক্রিকেট কালচার গড়ে না ওঠাকেই দেখি। আমরা এখনো ক্রিকেট বলতে ঐ ওয়ানডে-ই বুঝি, ফলে ওডিআইটা যা কিছু খেলতে পারি।

সেই সাথে টিটুয়েন্টির ক্রেজ, দর্শক-সমর্থকদের টিটুয়েন্টি নিয়ে আগ্রহ- সব মিলিয়ে টেস্ট সম্পর্কে প্রোপার আণ্ডারস্টাণ্ডিং-এই বিশাল ঘাটতি আছে আমাদের। সেটা দর্শক সমর্থক সাংবাদিক থেকে শুরু করে, বোর্ড, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক, এমনকি খেলোয়াড়দের মধ্যেও! ম্যাচ বাঁচাতে ১৫০ ওভারের বেশি টিকতে হবে এরকম ম্যাচে খেলতে নেমে এমনি এমনিই সাঈফ ছক্কা মারতে যায় নাই বা মুশফিক রিভার্স সুইপ, স্কুপ খেলে নাই! এ প্রসঙ্গে আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায়!

প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেট পড়ার পরেও তামিম যেভাবে কাউন্টার এটাক করে খেলে ৯৮ বলে ৭৮ রান করেছে- সেটা নিয়ে চারদিকে ব্যাপক প্রশংসা হয়েছে, টিভি রিপোর্ট হয়েছে, ক্রিকেটীয় ইউটিউব চ্যানেলে প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছড়ানো হয়েছে, সেগুলোর কোনটাতেই মুমিনুলের ৮৬ বলের ২৩ রানে দুর্দান্ত ইনিংসটা নিয়ে একটা বাক্যও বরাদ্দ রাখা হয়নি। বরং, একটা ইন্টারভিউতে দেখলাম, সাংবাদিক মুমিনুল কেন তামিমের মত এটাক করে খেলতে পারেনি সেই প্রশ্ন করেছে এবং মুমিনুল নিজের ব্যাটিং এর ধরণ নিয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছে এই বলে যে, সবার খেলার ধরণ এক রকম না, আমিও যদি তামিম ভাইয়ের মত মেরে খেলতাম তাহলে হয়তো দ্রুত ৫-৬ উইকেট পড়ে যেত … ইত্যাদি।

আমাদের সামনে আসলে টেস্ট ব্যাটিং এর সবচাইতে বড় বিজ্ঞাপন হচ্ছে তামিম, আমরা তুলনা করি শেবাগ, ভিভ রিচার্ডস, ওয়ার্ণারের সাথে! ফলে, সবাই তামিম, শেবাগ হতে চাই- কেউ দ্রাবিড়, পুজারা হতে চাই না! তামিম, শেবাগরা অন্য ধরণের ট্যালেন্ট- ঐটা জোর করে হতে চাইলে সাঈফ, মুশি’র মতই পরিণতি হয়। তামিমের ২৬ বলে ২৪ রানের ইনিংসে সাইফ, মুশির মত একটাও তেড়েফুঁড়ে মারা শট নেই, সবই সোজা ব্যাটে দারুণ ক্রিকেটীয় শট, অথচ তামিম, শেবাগ হতে চাওয়াদের কি কুৎসিত ব্যাটিং দেখেন!

এই তামিম কেবল মিডিয়ার সামনেই বিজ্ঞাপন নয়, আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক- এদের কাছেও সম্ভবত স্ট্যাণ্ডার্ডটা হচ্ছে ঐ তামিম। কেননা তারা স্কোয়াডে, একাদশে খেলোয়াড় বাছাই করে- রান দেখে, বল সংখ্যা বা সিচুয়েশন অনুযায়ি ব্যাট করতে পারা – না পারা দেখে নয়! ওয়ানডের বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান সৌম্য সেজন্যে টেস্টে সুযোগ পায়, ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাসে থার্ড ক্লাস পারফর্ম করা মিথুন কয়েকটা ওডিআই ইনিংসের কল্যাণে কতগুলো টেস্ট খেলে ফেলে! অথচ, ফার্স্ট ক্লাসে ৬০ গড়ের মোসাদ্দেকের টেস্টে সুযোগ মিলে না!

এই মোসাদ্দেক শ্রীলংকার বিরুদ্ধে পঞ্চম দিনে পাঁচ উইকেট পড়ার পরে নেমে ৫৩ বল খেলে ৮* রান করেছিলো, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে লজ্জার হারের টেস্টে ৮ নাম্বারে নেমে টপের ৭ ব্যাটারের সবার চাইতে বেশি বল খেলেছিলো- ৮২ বলে ৪৮ রানে নট আউট ছিল, মানে রশিদ খানরা তাকে আউট করতে পারেনি, এসব ইনিংস নিয়ে কথা হয় না। এবারও সলিড ডিফেন্সের, দুর্দান্ত টেম্পারমেন্টের সাদমানের বদলে সাইফকে নেয়ার মাধ্যমে সবার কাছে এই ম্যাসেজই দেয়া হলো যে, ঐ লেভেলের টেম্পারমেন্টের দরকার নাই, মেরেকেটে অনেক রান তুলতে পারলেই হলো, সাইফের মত এনসিএলের দুই টেস্টে ৫৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা, সর্বোচ্চ আট টা ছক্কা মারার অ্যাবিলিটিটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে!

বাংলাদেশের এ যাবতকালের সবচাইতে সলিড ডিফেন্সের, সবচাইতে টেম্পারমেন্টওয়ালা ব্যাটসম্যান নাঈম ইসলাম যেইভাবে টেস্ট দলে অচ্ছ্যুত গন্য হয়েছে (কিন্তু অদ্ভুত কারণে অনেকগুলো ওডিআই এ সুযোগ পেয়েছে), নাঈমের চাইতে দ্রুত রান করতে পারা নাসির টেস্ট দলে ঢুকেছিলো, এবারও সাদমানকে বাদ দিয়ে সাঈফকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ম্যাসেজটা অন্য ব্যাটারদের কাছে কি যাচ্ছে তাহলে? ধৈর্য ধরে টিকে থাকা, বলের পর বল ছাড়তে পারা, সলিড ডিফেন্স করা, সোজা ব্যাটে খেলে যাওয়া- এগুলোর দরকার নাই, মেরে কেটে রান করে যাও! ফলে, সেদিকেই সবার মনোযোগ!

  • প্রস্তুতির ঘাটতি

নতুন খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুব প্রকটভাবে বুঝা যায়! ঘরোয়াতে ধারাবাহিকভাবে রান করা, উইকেট নেয়া খেলোয়াড়দের যখন ইন্টারন্যাশনালে নিয়ে আসা হয়, এখানে এসেই সবাই ডাব্বা মারে। কেউ বা প্রথম এক দুটা ম্যাচে ঝলক দেখায়, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে পারে না! ইন্টারন্যাশনালে আসলেই প্রকটভাবে বুঝা যায়, তারা কতখানি অপ্রস্তুত! তো, একটা খেলোয়াড় প্রস্তুত হবে কোথায়?

অবশ্যই প্রথমত ঘরোয়া ক্রিকেটে, তারপরে পাইপলাইনের খেলোয়াড়দের দেশে বিদেশে বিভিন্ন কণ্ডিশনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বয়সভিত্তিক দল, এ দল, ইমার্জিং দল, বিসিবি একাদশ- এরকম নানা দলের হয়ে ট্যুরে খেলে খেলে প্রস্তুত হবে! সেদিন এক দেশীয় সম্মানিত কোচের সাক্ষাৎকারে দেখলাম, তিনি বলছেন- ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা যেহেতু খুব খারাপ, সেহেতু পাইপলাইনের ক্রিকেটারদের ঘন ঘন বিদেশে খেলিয়ে প্রস্তুত করা উচিৎ। আমি একমত নই! এ দল, ইমার্জিং দল, বিসিবি একাদশের ঘন ঘন ট্যুর দরকার (যেখানে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে আমাদের বোর্ড), কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটটাই হচ্ছে একদম মূল।

এটাকে বাদ দিয়ে বিদেশে যতই ট্যুর করানো হোক না কেন, কোন লাভ হবে না! কিন্তু আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কোন ঠিক ঠিকানা নেই, যাকে বলে কোন মা-বাপ নাই। ফলে, ইন্টারন্যাশনালে এরকম ছন্নছাড়া অবস্থার পেছনে আমাদের ছন্নছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটই মূল দায়ী। ঘরোয়া ক্রিকেট অবকাঠামোটাই বিশাল প্রশ্নবোধক হয় আছে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ২০ বছর পরেও! উইকেটের সমস্যা বড় সমস্যা। কোয়ালিটি উইকেটে খেলা হয় না। এর মানে কি? তামিম দারুনভাবে বিষয়টা বলেছে, আমাদের তিন ধরণের উইকেটই দরকারঃ পেস সহায়ক ঘাসের উইকেট, স্পিন সহায়ক উইকেট আর কিছুটা ফ্লাট ও স্পোর্টিং উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন ধরণের উইকেটেই নিয়মিত খেলা হওয়া দরকার। তামিম অকপটে স্বীকার করে বলেছে, বাইরের কোন দল আসলেই আমরা স্পিন উইকেট বানানোর কথা বলি, কিন্তু আমরা নিজেরাই তো টার্নিং উইকেটে খেলে অভ্যস্থ নই। সেদিনও ঘরোয়া একটা ম্যাচে বরিশাল ৮০ ও ৬০ রানে আউট হলো, রাজশাহীও দেড়শ রানে শেষ। তাইজুলকে জিজ্ঞেস করেছি- কি ঘটনা, সে জানালো প্রথম দিন থেকেই স্পিন ধরেছে। আর তাতেই ব্যাটসম্যানরা হাঁসফাঁস করেছে। এটা তো গেল উইকেটের সমস্যা, এর সাথে আছে আউটফিল্ডের অবস্থা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সমস্যা! কিন্তু আরো বড় সমস্যা হচ্ছে- আমাদের তো কোন সুনির্দিষ্ট ক্যালেণ্ডারই নাই। প্রতিবছর কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেয়- কবে কোন টুর্নামেন্ট বা লিগ শুরু হবে, কি হবে না! ফার্স্ট ক্লাসের দুটো লীগ আছেঃ এনসিএল আর বিসিএল, একটায় ৮ দল (৪ দল করে দুটো গ্রুপে খেলে), অন্যটায় ৪ দল। এনসিএল, বিসিএল ঠিকভাবে হলে বছরে একজন সর্বোচ্চ ১২-১৩ টা ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় (যারা এনসিএল-বিসিএল দুই লিগেই খেলতে পারে)। এনসিএলে সাতটা বিভাগীয় দল (ও একটা ঢাকা মেট্রো) থাকলেও এখনো সবার নিজস্ব ক্রিকেট একাডেমি সহ ক্রিকেটীয় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নাই।

হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিটাও ঠিকঠাক হয় না। অথচ, আটটা দলকে যদি সবার সাথে সবার হোম এণ্ড এওয়ে ভিত্তিতে খেলানো যেত, তাহলে এনসিএল এর ম্যাচই একেকজন পেত ১৪ টা করে, ৮ এর জায়গায় যদি ১০ টা দল করা যায় (যেমনঃ ময়মনসিং আর বগুড়াকে ইনক্লুড করার মাধ্যমে) – তাহলে একেক দল একেক মৌসুমে ১৮ টা ম্যাচ খেলতো! এর মধ্যে ৫-৭ টা করে ম্যাচ যদি ভিন্ন ধরণের উইকেটে খেলা হতো, ভিন্ন উইকেটে, ভিন্ন সিচুয়েশনে খেলার অভ্যস্থতা গড়ে উঠতো! এই ১০ দলে কারা খেলবে? একটা বড় অংশ লোকালরা, আর বাকিটা পুলের।

লোকালরা কিভাবে সুযোগ পাবে? একেকটা বিভাগীয় দলের অধীনে থাকা জেলাগুলোর (৬-৭ টা জেলা) মাঝে চলা লীগ থেকে প্লেয়ার বাছাই করে সুযোগ পাবে। মানে, জেলা লেভেলে পর্যন্ত দল থাকতে হবে, তাদের মধ্যে লিগ চলতে হবে। পারলে- উপজেলা লেভেলে স্প্রেড করতে হবে, মানে উপজেলা লেভেলে ক্রিকেট খেলেই জেলা দলে সুযোগ পাবে। অনুর্ধ্ব-১৯ এর জন্যে স্কুল লিগ চালু থাকাটাও জরুরী! সাথে বিভাগীয় দলগুলোর নারী ক্রিকেট দল থাকতে পারে, সম্ভব হলে জেলা লেভেলেও! এভাবে পর্যায়ক্রমিক ক্রিকেট অবকাঠামোটা দরকার। ঘরোয়া ক্রিকেটের এরকম শক্ত অবকাঠামো বাদে কোনদিনও আগানো যাবে না!

ঘরোয়ায় অনেক রান করা কেউ কয়েকটা ম্যাচ ইন্টারন্যাশনালে ব্যর্থ হলেই সমালোচনা, ট্রল, গালাগালির বন্যা বইয়ে দিয়ে কোন কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না! বুঝতে হবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে যারা খেলছে- তাদের সবার জন্যেই উইকেট, সিচুয়েশন, সুযোগ সুবিধা- সব একই। একই সুযোগ সুবিধা পেয়েও যে অনেক রান করা, উইকেট পাওয়াদের মত পারফর্ম করতে পারছে না, তার ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত পারফর্ম করাদের চাইতে আরো অনেকগুন বেশি।

সে কারণেই ঘরোয়ায় পারফর্ম করা মোসাদ্দেক, লিটন, ইয়াসির, নাঈম ইসলাম, সাদমান, শান্ত, তুষার ইমরান প্রমুখের আগে ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাসে পারফর্ম করতে না পারা ইমরুল কায়েস, মিথুন, সৌম্য সরকারদের টেস্ট ক্যাপ পড়ানো, একের পর এক টেস্ট খেলানোটা রীতিমত ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে! লিটন, শান্ত, সাদমানরা ইন্টারন্যাশনালে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে ব্যর্থ হলে – ঘরের বাঘ ইন্টারন্যাশনালে বিড়াল বলে টিটকারি না দিয়ে, বা ঘরোয়ার পারফর্মেন্স এর কোন দাম নাই, ঘরোয়া রেকর্ড দেখে লাভ নাই- এইসব না বলে বরং ঘরোয়া ক্রিকেটকে পাল্টানোর আলাপটা বেশি জরুরী।

ঘরোয়া ক্রিকেট যদি এমন ছন্নছাড়া হয়, ঘরোয়া ক্রিকেট যদি কিছু শেখাতে না পারে, ঘরোয়া ক্রিকেট যদি ক্রিকেটারদের প্রস্তুত করতে না পারে, তাহলে তাদেরকে ইন্টারন্যাশনালে এসেই শিখতে হবে বৈকি। সেই শেখার সময়টা ধৈর্য ধরে তাদের দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই আসলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link