চেলসি ভক্তদের কাছে ১৯০৫ সাল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। কারণ সে বছরেই গাস মেয়ার্স নামক এক ভদ্রলোকের হাত ধরে গোড়াপত্তন ঘটে ব্লুজদের। তার আগের বছর বর্তমান স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ কিনে নেয়া মেয়ার্স সিদ্ধান্ত নেন ফুটবল দল গঠনের। সিদ্ধান্ত নেবার পাশাপাশি দল গঠনের কার্যক্রম শুরু হলেও পাওয়া যাচ্ছিল না গোলকিপার।
অবশেষে কাঠখড় পুড়িয়ে শেফিল্ড ইউনাইটেড থেকে ৫০ ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়ানো হয় দীর্ঘকায় উইলিয়াম ফোলকেকে। কিন্তু চেলসিতে যোগ দেবার সময় ফোলকে কি জানতেন তার কারণেই ফুটবলে একসময় সৃষ্টি হবে নতুন এক ধারার?
৬ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার মোটাসোটা ফোলকেকে প্রথম দর্শনে যে কেউ জাপানের সুমো কুস্তিগির বলে ভেবে বসবেন। তবে ১৫২ কেজি ওজনের এই স্থুলকায় ফোলকে নিজের সময়ের সেরা গোলকিপারদের একজন ছিলেন। বিশেষ করে পেনাল্টি ঠেকাতে তার জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন মাঠে তার বিখ্যাত মেজাজের কারণে এবং তিনি বল হাতে না ধরে পা দিয়ে ক্লিয়ার করতেই বেশি পছন্দ করতেন। বর্তমান সময়ে সুইপার কিপারদের বদৌলতে ব্যাপারটা সবার পরিচিত হলেও তখনকার দিনে এটা ছিল একেবারেই নতুন। চেলসিতে যোগ দেবার পূর্বে তিনি শেফিল্ডের হয়ে দুবার এফএ কাপ জেতেন।
আর এই ফোলকের কারণেই ফুটবলে বল বয় ব্যাপারটা চালু হয়েছিলো বলে কিংবদন্তি আছে। আজকে সে গল্পই হবে।
২১ বছর শেফিল্ডে কাটানোর পর চেলসিতে যোগ দেন তিনি। তার অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্বগুণের কারণে যোগ দেবার পরই তাকে সরাসরি অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করে ব্লুজরা। নিজের প্রথম মৌসুমেই চেলসির হয়ে দারুণ পারফর্ম করেন ফোলকে। পুরো মৌসুমে দশটি পেনাল্টি সেভ করেন তিনি। চেলসিকে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে তুলে আনেন প্রথম বিভাগে। তার উচ্চতা এবং দীর্ঘকায় শরীর দেখে গোলপোস্টে যেন শট নিতে ভুলে যেতেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা।
তার সময়ে গোলকিপারের পিছনে দুজন শিশু রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করে চেলসি। আইডিয়াটি দারুণ জনপ্রিয় হয় দর্শকদের মাঝে। মূলত দর্শকদের দেখানোর কথা বললেও আসল কারণটি ছিল ভিন্ন। মূল কারণটি ছিল দীর্ঘকায় ফোলকেকে আরো বিশালাকার দেখানো,। যাতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা শুরুতেই কিছুটা ভড়কে যান। যদিও এমনিতেই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা ফোলকেকে যথেষ্ট সমীহ করে চলতেন।
তবে চেলসি কর্তৃপক্ষের এই আইডিয়া দারুণভাবে কাজে লেগে যায় ফোলকের জন্য। তখনো ফুটবলে বলবয়ের প্রচলন হয়নি। তাছাড়া তখন স্টেডিয়াম এখনকার মতো উন্নত না হওয়ায় বল জোরে শট করলে দূরে চলে গেলে ভারী শরীরের ফোলকের আনতে যেতে কষ্ট হবার পাশাপাশি অনেক সময় নষ্ট হতো। সেজন্য দেখা যেত প্রায়শই ফোলকে বাচ্চাদের পাঠিয়েছেন দূরের বল নিয়ে আসার জন্য।
এখনকার স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দর্শকধারণক্ষমতা বেড়েছে, আধুনিক সু্যোগ-সুবিধা বেড়েছে, মাঠের চারপাশে অ্যাথলেটিক ট্র্যাক থাকার দরুণ বল বাইরে যাবার সুযোগ কম। কিন্তু বল বয় ব্যাপারটা ফুটবলেরই অংশ হয়ে গেছে। মূলত ফোলকের এই ধারণা থেকেই পরবর্তীতে ফুটবলে বলবয়ের প্রচলন শুরু হয়।
ইংলিশ ফুটবলের প্রথম সুপারস্টার বলা হয়ে থাকে তাকে। মাঠে তার আগ্রাসী মনোভাবের পাশাপাশি মজার সব কান্ড দর্শকদের আমোদিত করতো। তাকে নিয়ে রূপকথার মতো অনেক গল্প রচিত হয়েছে পশ্চিম লন্ডনের বাসিন্দাদের মুখে।
ফোলকে ছিলেন দারুণ একজন স্পোর্টসম্যান। দীর্ঘকায় এই শরীর নিয়ে তিনি ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলতেন। ১৯০০ মৌসুমে তিনি ডার্বিশায়ারের হয়ে চারটি একদিনের প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন। দুটো খেলাতেই পারদর্শীতা ফোলকের অসামান্য ক্রীড়া দক্ষতার জানান দেয়। এছাড়াও খেলোয়াড়ি জীবনে একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
চেলসিতে মাত্র এক মৌসুম কাটিয়েই তিনি ব্ল্যাকপুলে যোগ দেন। সেখানেই দুই মৌসুম কাটিয়ে ১৯০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর মাতিলদা স্ট্রীটে একটি বার খুলেছিলেন, সেখানেই নিজের অবসর সময় যাপন করতেন। কিন্তু খেলাধুলার ইতিহাসের এই বর্ণিল চরিত্র ১৯১৬ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান। তাকে শেফিল্ডে সমাহিত করা হয় কারণ সেখানেই তিনি কাটিয়েছিলেন নিজের জীবনের সর্বাধিক সময়।