বিতর্ককে কাছে টেনে নেন, আবার সেই বিতর্ককেই দূরে ঠেলে বাউন্ডারির ওপারে পাঠিয়ে দেন। সাকিবের বেলায় লাইফস্টাইলের সংজ্ঞাটা বোধহয় এমনই। যখনই বিতর্ক চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে তখনই মাঠের ক্রিকেটে কিছু একটা করে ফেলেন। নিন্দিত সাকিব হয়ে ওঠেন নন্দিত।
এই এবারের বিপিএলের কথাই ধরা যাক। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তীক্ষ্ণ কথার প্রশ্নবাণে বিসিবিকে রীতিমত জর্জরিত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেললেন। সাকিব বললেন। প্রত্যুত্তরে ও পাশ থেকেও কত কথা আসলো। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সাকিবের। একটা চলমান প্রক্রিয়া কিংবা প্রথাকে তোয়াক্কা না করে সাকিব ছুটে চললেন সাকিবের মতোই। একদম নিজস্ব এক স্টাইল অনুসরণ করে চলেন বাংলার ক্রিকেটের নবাব।
সাকিবের কাছে ক্রিকেটটা আর আগের মত প্রথম অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয় না। এমন কথা প্রায় সময়েই শোনা যায়। সাকিব নিজেও অবশ্য এমন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছেন অনেকবার। সাকিবের নিজস্ব ব্যবসা আছে, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্টের জন্য বিজ্ঞাপনের ব্যস্ততা আছে। আর তার সাথে পরিবারকে আলাদা করে সময় দেওয়ার জন্য ঢাকা টু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র টু ঢাকা প্রায় সময়েই করতে হয়।
এমন নানাবিধ কারণে স্বাভাবিকভাবেই সাকিব ক্রিকেটকে আর ‘প্রথম’ এ রাখতে পারছেন না। কিন্তু এখানেও এক সাকিবীয় ঘরানা তৈরি হয়েছে। সাকিব ক্রিকেটকে প্রথমে রাখেন না, কিন্তু তিনি ক্রিকেট মাঠে নিজেকে প্রথমে রাখেন। নিজের ছন্দচ্যুতি কখনোই ঘটতে দেন না।
দশ বছর আগের বিপিএলে সাকিব খেলেছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার সেরা ৮৬ রানের ইনিংস। সময় গড়িয়েছে। প্রথাগতভাবে সাকিবেরও ধার কমার কথা। কিন্তু কিসের কী! নামটা সাকিব বলেই হয়তো ১০ বছর আগের আগের রেকর্ড এখন ১০ বছর পরে এসে ভাঙছেন। এবারের বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে খেললেন ৮৯ রানের এক ইনিংস। সেই ইনিংস আবার আসলো কোনো অনুশীলন ছাড়াই।
হ্যাঁ। একদম ঠিকই শুনেছেন। কোনো প্র্যাক্টিস সেশন ছাড়াই সাকিব অমন ইনিংস খেলেছেন। সাকিব এই ইনিংস খেলার আগে একটি বিজ্ঞাপনে শ্যুটিং করেছেন। আবার ইনিংস খেলার পর বিমান ধরে চলে গিয়েছেন ঢাকায়। কারণটা পরিবারকে সময় দেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটে পরিবারকে পৌঁছে দিতে বিপিএলের চট্টগ্রাম পর্বের মাঝপথে চলে গেছেন ঢাকায়। এমনটা আসলেও ভাবা যায়?
আপনি চাইলেও সাকিবের এমন কান্ডের সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু সেই সমালোচনার বিপরীতে আপনাকে এটাও যোগ করতে হবে যে, সাকিবের এমন কান্ডের পরও তিনি মাঠের খেলায় কোনো প্রভাব পড়তে দেননি। ম্যাচের সময়ে মাঠে যাচ্ছেন। অধিনায়কত্ব করেছেন। ব্যাট হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এমন না, কোনো দায়সারা অধিনায়কত্ব করে কোনো রকমভাবে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য দলের যেকোনো অধিনায়কের চেয়ে মাঠে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন সাকিব। যখন যাকে ব্যাটিং পজিশনে তোলা প্রয়োজন সেখানেই তাঁকে তুলছেন।
নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে মিরাজকে ব্যাটিং করার সুযোগ দিচ্ছেন। নিজে ব্যাট হাতে জ্বলে উঠছেন প্রতি ম্যাচেই। বরিশালের রানের গতি বাড়ানোর দায়িত্ব নিচ্ছেন। অপর প্রান্তে থাকা ব্যাটারকে সময় দিচ্ছেন নিজে ঝুঁকি নিয়ে। একদম দুর্দান্ত নেতৃত্ব যেটাকে বলা যেতে পারে, ঠিক তেমনটাই আছেন মাঠের ক্রিকেটের সাকিব।
এই মাঠের ক্রিকেটের বাইরে সাকিব যা কিছুই করে বেড়ান না কেন অন্তত তার প্রভাব দলে আসে না। সেটা নিজ গুণেই তিনি আসতে দেন না। ব্যাট হাতে রীতিমত দুর্দান্ত এক বিপিএল কাটাচ্ছেন তিনি। ৩ ফিফটিতে ২৭৫ রান করে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটারের নাম সাকিব। নিজ পারফর্ম্যান্স দ্যুতিতে নিজের দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন শীর্ষে। শুরুটা হার দিয়ে হলেও এরপরে টানা ৫ টি ম্যাচ জিতেছে বরিশাল। মজার ব্যাপার হল, সাকিবের অধিনায়কত্বে এখন পর্যন্ত একটি ম্যাচেও হারেনি ফরচুন বরিশাল।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটার সাকিবকে নিয়ে সমালোচনার বেশ জায়গা ছিল অনেক দিন ধরেই। কিন্তু এবারের বিপিএলে এসে দেখা মিলল অন্য এক সাকিবের। ব্যাট হাতে প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েছেন তিনি।
শেষ ম্যাচে ৩০ রানে আউট হয়ে ফিরেছিলেন বটে। কিন্তু বরিশালের রানের গতিটা তিনিই বাড়িয়ে দেন। তবে সাকিবকে নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে তাঁর ব্যাটিং অনুশীলন নিয়ে। টুর্নামেন্ট চলাকালীন ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন কম। তারপরও কিভাবে ব্যাট হাতে সফল হচ্ছেন সাকিব?
বরিশালের কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম আবার সাকিবের এমন প্রক্রিয়াকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তাঁর মতে, একটা ৮০ রানের ইনিংস খেলার পর নেটে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস বরং শটের ইন্টেন্সিটি কমিয়ে দিতে পারে। আর সে কারণেই টুর্নামেন্ট চলাকালীন সাকিবের অনুশীলনের আহামরি প্রয়োজন নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, সাকিবের কাছে ক্রিকেট এখন প্রথম প্রায়োরিটি না হলেও তিনি নিজে বোঝেন কখন কী করতে হবে। আর এই বোধটাই সাকিবের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
হ্যাঁ। সাকিবের এই অনন্যতা হয়তো তরুণ কোনো ক্রিকেটারের জন্য পথ প্রদর্শক হতে পারে না। কিন্তু দিনশেষে মাঠের ক্রিকেটে সাকিব সিংহভাগ সময়েই সফলদের কাতারে থেকে যান। অনেক ক্রিকেটারই ঘন্টার পর ঘন্টা মাঠের অনুশীলনে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
কিন্তু, ম্যাচে তার প্রতিফলন দেখাতে পারেন কম। সাকিবের বেলায় সেটা পুরোপুরি আলাদা। সাকিবের মাঠের ক্রিকেটে নিজের ছাপ রাখেন মোটা দাগে। আর দিনশেষে, আলোচনা হয় এই মাঠের ক্রিকেটের পারফরম্যান্স নিয়েই। তাই সাকিব সব সময় আলোচনার কেন্দ্রেই থাকেন। হোক সেটা মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে।