নুয়ান কুলাসেকারার ফুলার লেন্থের বল। সজোরে হাঁকালেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। লং অন ও ফাইন লেগের মধ্যখান দিয়ে রাতের আকাশের অন্ধকার চিরে সাদা বল ক্রমশ ধাবমান। সে বল যে থামবার নয়। সে বল যেন অন্ততকাল ধরে উড়ে চলছে ইতিহাসের পাতায়। সেদিনের সে ছয় নিয়ে হতে পারে মহাকাব্যের মিছিল। তবে সে মহাকাব্যে পেছনে যে ছোটছোট গল্প ছিল সেগুলো আড়াল হয়েই রয়।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভারতের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনাল। শুরুতেই স্বাগতিকদের দুই ভরসার স্তম্ভের পতন। বীরেন্দ্র শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার তখন সাজঘরের শোভা বাড়ায় কিংবা চাপ। তবে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নেন অভিজ্ঞ গৌতম গম্ভীর ও তরুণ বিরাট কোহলি। এর পরেই যেন এক পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের ফলেই হয়ত সুখকর এক পরিসমাপ্তি।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছিলেন যুবরাজ সিং। তবে সেদিনের ফাইনালে পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করতে এসেছিলেন ধোনি। এ নিয়ে প্রশ্ন হয়েছে বারংবার। বহুবার এই প্রশ্নবাণে ঘায়েল হয়েছেন যুবরাজ সিং। তবে তিনি বরাবরই বলেছেন, ‘মাহির আমার আগে ব্যাটিং করতে যাওয়াটা ছিল দলের সিদ্ধান্ত। গম্ভীর আর বিরাট ব্যাটিং করার সময় ভিরু, শচীন, গ্যারি ও ধোনি মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ডান-বাম কম্বিনেশনের প্রয়োজন। তাই বিরাট আউট হলে ধোনি নামবে এবং গম্ভীর আউট হলে আমি।’
তবে সেদিন আরও এক ফ্যাক্টর কাজ করেছিল ধোনির আগে ব্যাটিং করতে নামার পেছনে। ধোনির আত্মবিশ্বাস ছাড়াও সেদিন মুত্তিয়া মুরালিধরন ছিলেন অন্যতম কারণ। কেননা যুবরাজ সিংয়ের একটু দূর্বলতা ছিল স্পিন বোলারদের বিপক্ষে। অন্যদিকে ধোনি ছিলেন স্পিন বলের বিপক্ষে দারুণ ব্যাটার। এই একটা কারণেও সেদিন যুবরাজের আগে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন ধোনি।
ধোনি যখন ব্যাটিং করতে নামছিলেন তখন দুই প্রান্ত থেকেই লংকান স্পিন বোলাররা বল করে যাচ্ছিলেন ধারাবাহিকভাবে। তাই হয়ত যুবরাজ সিংয়ের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ উইকেট ভারত দলের টিম ম্যানেজমেন্ট ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে চাইছিল না। যুবরাজ নিজের সে দূর্বলতা কখনোই লুকানোর চেষ্টা করেননি। বরং সেখান থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজেছেন।
তাঁর স্পিন দূর্বলতা নিয়ে যুবরাজ একবার বলেছিলেন, ‘আমার বাবা ছোট বেলায় আমাকে সতের গজের এক উইকেটে ভেজা টেনিস বল, ভেজা চামড়ার বল দিয়ে অনুশীলন করাত। সে আমাকে গতিশীল পিচগুলোতে খেলার জন্যে প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। সে জানত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফাস্ট বোলারদের খেলতে হয়ে আমার সাহসের প্রয়োজন রয়েছে। সে আমাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন।’
বাবার এমন প্রশিক্ষণের কারণেই যুবরাজ ছিলেন পেসারদের বিপক্ষে একেবারে ভয়ডরহীন। তিনি পেসারদের আগ্রাসী চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারতেন। তবে তিনি ভাল মানের স্পিনারদের বিপক্ষে ছিলেন দূর্বল। তিনি বলেন, ‘আমি মোটামুটি স্পিন খেলতে পারি। তবে মুত্তিয়া মুরালিধরনদের মত বিশ্বমানের স্পিনারদের বিপক্ষে খেলাটা সম্পূর্ণ আলাদা।’
যুবরাজের এই স্পিন দূর্বলতা বা মুরালিধরনকে নিয়ে হওয়া তাঁর দুশ্চিন্তার কথা নিশ্চয়ই জানত টিম ম্যানেজমেন্ট। সেজন্যই হয়ত তাঁরা কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাননি। ঘরের মাঠে শিরোপার এতটা কাছে গিয়েও হাতছাড়া করে ফেলাটা বড্ড বড় বোকামি। সে বোকামির উদাহরণ নিশ্চয়ই ভারত ক্রিকেট দল হতে চায়নি। আর তাই হয়ত সেবার যুবরাজ আকাশে তুলতে পেরেছিলেন বিশ্বকাপের সেই সোনালী ট্রফি।