দিব্যি ছিলেন নাসুম আহমেদ।
মনের আনন্দে ক্রিকেট খেলছিলেন। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলছিলেন সিলেটের হয়ে। গত বছর ছয়েক ধরে প্রিমিয়ার লিগও খেলছিলেন। এই খেলার আনন্দে খেলা। কোনো মোহ ছিলো না। এর মধ্যেই বিপিএলে খুব ভালো করে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে গেলেন। কোনো ম্যাচ জুটলো না কপালে। কিন্তু একটা ক্ষতি হয়ে গেলো নাসুমের।
লোভে পড়ে গেলেন সিলেটি এই বাহাতি স্পিনার!
প্রথমে মনে হয়েছিলো কথাটা ভুল করে বলে ফেলেছেন।
মুখ ফসকে তো কত কীই বের হয়ে যায়। সব কথা কী লেখা যায়! তাই আরেকবার জিজ্ঞেস করতে হলো, ‘লোভের কথা বলেছেন?’
তিনি একটু হাসলেন। আমার হতভম্ব ভাবটা উপভোগ করলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক শুনেছেন। আসলেই ইদানিং লোভী হয়ে উঠেছি। খুব লোভ হয় আমার?’
আরেকটু অবাক হলাম।
নাসুম এবার দয়াপরবশ হয়ে হেসে ব্যাখ্যা দিলেন, ‘আমার টাকার লোভ নেই, নামের লোভ নেই। ক্রিকেটের লোভে পড়ে গেছি, ভাই। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যে মানের ক্রিকেট খেলে, ওটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। আমি এখন ওই ক্রিকেট খেলতে চাই। জাতীয় দলেই থাকতে চাই। এই লোভ আমাকে পাল্টে দিয়েছে।’
লোকেরা এটাকে ক্রিকেটের ক্ষুধা বলে থাকে।
আরেকবার সেই ক্ষুধা মেটানোর একটু সুযোগ পেয়েছেন নাসুম। নিউজিল্যান্ডগামী দলে ডাক পেয়েছেন। এই দলে একমাত্র বিশেষজ্ঞ স্পিনার তিনি। ফলে মাঠে নামার সুযোগ হয়েও যেতে পারে এবার। আর সেটা হওয়া তার জন্য খুব জরুরী। কারণ এই স্তরের ক্রিকেটটা মাঠে নেমে খেলার বড় শখ যে তার।
নাসুম একেবারে সিলেট শহরেরই ছেলে।
এই শহর থেকে জাতীয় দল এ পর্যন্ত কম উপহার পায়নি। এনামুল হক জুনিয়র, তাপস বৈশ্য, অলক কাপালি বা রাজিন সালেহ। কিংবা এই আজকালকার এবাদত হোসেন, আবু জায়েদ রাহি বা খালেদ আহমেদ। এই ধারাটা ধরে রেখেই ক্রিকেটে এসেছেন নাসুম।
বাসায় সেভাবে আর কেউ খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন না। নাসুম মনের আনন্দে ফাঁকা মাঠ কিংবা গলিতে ক্রিকেট খেলে বেড়াচ্ছিলেন। সেই সময়ে সিলেট অনুর্ধ্ব-১৩ দলের ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। নাসুমের স্পিন সম্পর্কে জানতেন, এমন এক বড় ভাই বললেন, ‘তুই ওখানে যা।’
নাসুম খুব ভয়ে ভয়ে বাবাকে বললেন কথাটা। বাবা বললেন, ‘যেতে পারো। যদি মনে করো, ক্রিকেট খেলে কিছু করতে পারবা, তাইলে যাও। আর যদি ভালো খেলতে না পারো, তাইলে পড়াশোনা করো।’
নাসুম নিশ্চিত ছিলেন না যে, তিনি আদৌ কিছু করতে পারবেন কি না।
কার্যত ক্রিকেট খেলে কী হতে পারবেন, এটা নিয়ে কখনোই ভাবেননি; এখনও খুব একটা ভাবেন না। তারপরও ঝুকিটা নিলেন। আর ওই টুর্নামেন্টেই তার বোলিং নজরে পড়ে গোলাম ফারুক সুরুর। তিনি গিয়েছিলেন ওখানে একটা ক্যাম্পে। নাসুমের বোলিং দেখতে কিংবদন্তী পেসার সুরু আম্পায়ারের কাছে এসে দাড়িয়েছিলেন। আর তিনিই নাসুমকে নিশ্চিত করেন যে, ক্রিকেট খেলে কিছু একটা হতে পারবেন এই বাহাতি স্পিনার।
এরপর ঢাকায় এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব একটা সময় লাগেনি। ২০১১ সালে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে অভিষেক। এর মধ্যে বাংলাদেশের দুটো বয়সভিত্তিক দলেও নিয়মিত খেলে ফেললেন। অনুর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ, এমার্জিং এশিয়া কাপ খেললেন। শুরু হলো ঢাকার লিগে খেলা। সবমিলিয়ে নাসুম গত সাত-আট বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিয়মিত নাম।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে একজন বাহাতি স্পিনার হিসেবে চূড়ান্ত প্রাপ্তিটা ঘটনো একটু কঠিন। এখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে গাদা গাদা বাহাতি স্পিনার। জাতীয় দলে ও অপেক্ষায় থাকা স্পিনারদের তালিকাও কম লম্বা নয়। এদের টপকে জাতীয় দলে আসাটা একটু কঠিন।
তারপরও নাসুম চালিয়ে গেছেন। জাতীয় দলে ঢোকার চেষ্টায় চালাননি। নিজের আনন্দেই লড়ে গেছেন। অবশেষে গত বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দল ঘোষনা হলে নাসুম অবাক হয়ে নিজের নামটা আবিষ্কার করলেন।
আর এই নাসুমের জীবন বদলে গেলো।
নিজেই বলছিলেন, ‘আমি জাতীয় দলের সাথে ক দিন অনুশীলন করলাম। এরপর এই সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি খেললাম। এদের খেলার লেভেলই অন্যরকম। অনেক ভালো ক্রিকেট হয় ওখানে। আমার মনে হলো, আমি এতোদিন এরকম ক্রিকেটের অপেক্ষাতেই ছিলাম। আমাকে এই ক্রিকেটই খেলতে হবে। আমি এই ক দিন শুধু ভাবতাম, আবার কবে ডাক পাবো।’
তবে নাসুম কেবল লোভ করেই বসে আছেন, তা নয়। তিনি জানেন, এই জায়গাটায় টিকে থাকতে গেলে কী করতে হবে। নিজেকে তাই এই নিজের নতুন চাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ানোর চেষ্টা করছেন, ‘আমি জানি, জাতীয় দলে টিকে থাকা, সুযোগ পাওয়া এতো সোজা না। শুধু লোভ করলেই তো হবে না। আমি এখন অনেক বেশী পরিশ্রম করছি, অনেক কষ্ট করছি, নিজের ডেভেলপমেন্টের জন্য অনেক কষ্ট করছি।’
নাসুম হয়তো একদিন তার এই স্বপ্নের পূরণ করতে পারবেন। একদিন হয়তো লাল সবুজ জার্সিটা তার পাকাপাকিভাবে হয়ে যাবে। কিন্তু একটা হাহাকার নাসুমের থেকেই যাবে-মায়ের জন্য হাহাকার।
নাসুম যখন ক্রিকেটার হয়ে উঠছেন, বাবা ও মায়ের কাছ থেকে খুব সাপোর্ট পেয়েছেন। মা অবশ্য ছেলেকে দূরে দূরে রেখে খুব কষ্টে থাকতেন। করোনার সময়ে নাসুম যখন বাসায়ই থাকছিলেন। তখন মা বলছিলেন, ‘তুই এমন বাসায় থেকেই খেলতে পারিস না? আমাকে ছেড়ে দূরে যাস না।’
নাসুমের দিন বদলে যাচ্ছে। আর ক দিন পর হয়তো চাইলে মাকে এনে নিজের কাছেই রাখতে পারতেন। কিন্তু সেই মা-ই যে দূরে চলে গেলেন!
গত বছর হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন নাসুমের মা।
এই হাহাকার নিয়েই তাই নাসুমকে এগোতে হয়। তারপরও ওপরের দিকে চেয়ে নাসুম স্বান্তনা খোজেন। ধরা গলায় বলেন, ‘আমি ভালো করতে চাই। ভালো করলে মায়ের আত্মা হয়তো শান্তি পাবে। মায়ের জন্য হলেও ভালো খেলতে হবে।’
এই তো মানুষের জীবন।