অধিনায়ক তামিম ও বুড়ো হাঁড়েদের ভেলকি!

২০১৯ বিশ্বকাপের পরপরই শ্রীলঙ্কা সফর করেছিলো টিম টাইগার্স।

শ্রীলঙ্কা যাওয়ার ঠিক আগের দিন হুট করেই পুরো দলের দায়িত্ব বর্তায় ওপেনার তামিম ইকবালের কাঁধে। তামিম নিজেও জানতেন না এই সফরে দলের গুরুদায়িত্ব তার কাধেঁই থাকবে। আচমকা নেতৃত্ব পেয়ে সফল হতে পারেননি তামিম।

৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়া টাইগারদের পারফরম্যান্সের বিচার-বিবেচনা করা হয়েছিলো এক তামিম ইকবালকে দিয়ে। ব্যাটে ছিলো না রান, দল জিততে পারে নি একটি ম্যাচও আর এর সব দোষ যেন একা তামিমের। হুট করে কেন শ্রীলঙ্কা সফরের কথা বলছি সেটা ক্রিকেটবোদ্ধারা বুঝে গেছেন নিশ্চিত।

অনেকেই জোর গলায় দাবি করেছিলেন তামিম একজন ভালো ব্যাটসম্যান হতে পারেন তবে ভালো অধিনায়ক না। কিন্তু ঐদিন থেকেই আমি ব্যক্তিগত ভাবে অপেক্ষা করেছিলাম একটা ভালো সুযোগের। এইভাবে আচমকা দায়িত্ব দিয়ে যদি ভালো অধিনায়ক নির্বাচন করা যেতো তবে বড় বড় দলগুলোও এমন নিয়মের বাইরে যেতো না।

এমনটা বলছি না একটা ‘সি’ ক্যাটাগরির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে হোয়াইটওয়াশ করে তামিম সেরাদের সেরা অধিনায়ক বনে গিয়েছে!

আমি বলবো অধিনায়ক হিসেবে তামিমের শুরুটা নিয়ে। দল যেমনই হোক একজন অধিনায়ক কতটা ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারেন সেটা তার সিদ্ধান্ত দেখলো বুঝা সম্ভব। মেহেদি হাসান মিরাজকে অধিনায়ক তামিম যেভাবে পুরো সিরিজে ব্যবহার করেছেন আমি বলবো তামিম ভবিষ্যতে অধিনায়ক হিসেবে কেমন হবেন তার একটা বার্তা দিলেন।

সবশেষ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি লিগে মিরাজ বল হাতে তেমন কিছুই করতে পারেন নি। স্কোয়াডে আরেকটা অপশন থাকার পরেও তামিম মিরাজের উপর আস্থা রেখেছেন এবং দিনশেষে মিরাজ অধিনায়কের সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। আমরা এর আগেও দেখেছি শুরুর দিকে পেসাররা প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের খানিকটা ছেপে ধরলে ব্যাটসম্যানরা স্পিন বোলার আসলে কিছুটা হাতে খুলে সিঙ্গেলের উপর খেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই সিরিজে অধিনায়ক তামিম যেভাবে প্রথম পাওয়ার প্লের শেষের দিকটা থেকে বোলিংয়ে পরিবর্তন এনেছেন সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। প্রথম দুটি ওয়ানডেতে হাসান মাহমুদ, সাকিব এবং মিরাজ এই তিনটে বোলারকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা উল্টো আরো বেশি বিপর্যয়ে পড়েছে।

এবার আর একটা উদাহরণ দেই। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ২৯৮ রানের বড় লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতে ফিজের বোলিং তোপে দুই ওপেনারকে হারায় উইন্ডিজরা। তবে খানিকটা সময় নিয়ে তৃতীয় উইকেটে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালান দুই ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান। ঠিক তখনই প্ল্যান বিতে চলে যান তামিম। নিজের হাতে সাকিবের মত একটা অভিজ্ঞ অপশন থাকা সত্ত্বেও মিরাজের উপর আস্থা রেখেছেন তিনি। এর আরেকটা বড় কারণ হলো উইকেটে থাকা ক্যারিবীয় বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের অফ স্পিনে দুর্বলতা। মিরাজ সেই সুযোগটাকে প্রথম দুই ওয়ানডের মত আজও কাজে লাগিয়েছেন। ফলে বড় কোন পার্টনারশিপ গড়ে উঠার বিপরীতে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে সফরকারীরা।

ক্রিকেটে সত্যি এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপারগুলো অনেক ব্যবধান তৈরি করে দেয়। তৃতীয় ওয়ানডেতে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের সর্বোচ্চ পার্টনারশিপ মাত্র ৩৮ রানের। এর পেছনে উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের যেমন দুর্বলতা রয়েছে ঠিক তেমনি অধিনায়ক তামিমের বড় এক ক্রেডিটও রয়েছে। তামিম অধিনায়ক হিসেবে কতটা সফল হবেন সেটা সময় বলে দিবে। তবে অধিনায়ক হিসেবে তামিম নিজেকে প্রমাণ করার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন কিনা সেটা বড় কথা। বাংলাদেশের সাবেক সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বলেছেন অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়টা যেন তামিমকে দেওয়া হয়।

এবার আসি আরেক মহাগুরুত্বপূর্ণ টপিকে। ২৫ জানুয়ারি ২০২১ দিনটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড়ই সুখকর। আর সুখকর এজন্যই যে দলের সবচেয়ে সিনিয়র চার ক্রিকেটার একই ম্যাচে পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে গেছেন। যদিওবা এটা নতুন ব্যাপার না তবে করোনাকালীন ক্রিকেটে এটা অবশ্যই অনেক বড় পাওয়ার।

লম্বা সময় পর ঘরের মাটিতে এই সিরিজ দিয়ে ক্রিকেটে ফেরা এবং বিগত দিনগুলোর মতো সিনিয়রদের হাত ধরে বড় এক জয়। অনেকেই সিনিয়রদের পারফরম্যান্স নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেন কিন্তু আজকের এই পারফরম্যান্স আপনাদের গোটা কয়েক প্রশ্নের উত্তর হলেও দিয়েছে। এবার কথা আসতে পারে একটা ম্যাচে চারজন পারফর্ম করে পার পেয়ে যাবেন কিনা। তবে আমি বলবো এই চারজনের বিকল্প ভাবার সময় এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেটে আসেনি।

লিটন দাস কিংবা নাজমুল শান্তের ব্যাট হাসলে অবশ্যই বাংলাদেশ এর চেয়েও বড় পুঁজি পেতো এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু যে সিচুয়েশন থেকে দলটাকে ৩০০ সমান পুঁজি এই চারজন এনে দিয়েছেন সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তামিম আর সাকিব কিছুটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট করেছেন এবং মুশি আর রিয়াদ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দ্রুত রান তুলে সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন। আমি অন্তত বিশ্বাস করি এসব ম্যাচ স্ট্রাইক রেট দিয়ে যাচাই করা উচিত না।

প্রশ্ন হতে পারে ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দল নিয়ে। আমি এখনো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের মূল ভরসা হতে পারেন এই চার সিনিয়র। লিটন, সৌম্য, শান্ত, আফিফরা আগামী দুই বছরে অনেকটাই পরিণত হবেন মানলাম কিন্তু এই চার সিনিয়রদের ছাড়া বাংলাদেশ দল ২০২৩ বিশ্বকাপে অসম্ভব। মোট কথা এই চারজন হবেন অটোচয়েজ; যদি কারো ইনজুরি জনিত কোন বড় সমস্যা না থাকে।

মুশি আর সাকিবে কারো সন্দেহ না থাকলেও প্রশ্ন উঠতে পারে তামিম আর রিয়াদকে নিয়ে। তামিম ক্ষেত্রে স্ট্রাইক রেট আর রিয়াদের ক্ষেত্রে রান এই দুটো জিনিসই তাদের বিপক্ষে প্রশ্ন তুলে। কিন্তু এই দুজন কোন সিচুয়েশনটাতে ব্যাট করেন সেটা আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই। কিন্তু দিনশেষে একটা বড় স্কোরের জন্য এই দুজনের অবদানই কিন্তু সবচেয়ে বেশি। তামিম একটা ভালো শুরু এনে দিলে আর রিয়াদ শেষের দিকে দ্রুত রান তুললে ৩৪০-৫০ এর মত পুঁজি বাংলাদেশ অনায়াসে পাবে।

কাজেই এটা বলবো ২০২৩ বিশ্বকাপের অজুহাতে যেন সিনিয়র সিটিজেনদের দলের বাইরে রাখার চিন্তা না করা হয়। মোহাম্মদ হাফিজ কিংবা শোয়েব মালিক এখনো পাকিস্তান দলের নিয়মিত সদস্য। এমনকি বোর্ড এখনো তাদেরকে বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছে সেক্ষেত্রে আমাদের কেন সিনিয়রদের ছাঁটাই করতে এত মাথাব্যথা? ক্রিকেট যেমন দিনদিন আধুনিক হচ্ছে তেমনি আমাদের এই চার সিনিয়র ক্রিকেটারও নিজেদেরকে সেভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন। তবে কেন তাদেরকে নিয়েই এত মাথা ঘামাতে হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link