প্রিয় বাবা,
জানি, এখন আর তোমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তবু, একটু চেষ্টা করে দেখো না, যা যা বলছি এই চিঠিতে, সব মনে পড়ে যাবে তোমার।
তুমি অটো চালিয়ে সেই আয়ে সংসার চালাতে। অভাবের সেই সংসারে অর্থ না থাকলেও শান্তি ছিল প্রচুর। বড় ভাই মোহাম্মদ ইসমাইল পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল। তাকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছিলে তুমি ওই সীমিত আয়ের বাউন্ডারির মধ্যে থেকেই। পড়তে ভালো লাগত না আমার সেই ছোটবেলা থেকেই।
আর আমার পড়াশোনা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলে তুমি আর মা। পড়া ছেড়ে আমার ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি খুব অপছন্দ ছিলো মায়ের। মা বকাবকি করলেই অবশ্য আমার সামনে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে তুমি। মনে পড়ছে, একান্তে মা শাবানা-কে কতবার তুমি বলেছিলে, ‘দেখো শাবানা, এই ছোট্ট সিরাজই একদিন দেশকে গর্বিত করবে।’
তোমাকে অটো চালাতে দেখে খুব কষ্ট হত আমার। মনপ্রাণ দিয়ে ক্রিকেটটা প্র্যাক্টিস করতাম। বোলিংয়ে আউটস্যুইংটা শিখতাম একটাই আশায় যে একদিন আমার আউটস্যুইংই সংসারের যাবতীয় না থাকাগুলোকে আউটস্যুইংয় করিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। আর বলে জোর আনার চেষ্টা করতাম, যাতে ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দ্যগুলো আমার বলের মতই দ্রুত উধাও হয়ে যায়। ব্যাটিংটাও অনুশীলন করতাম খুব, যাতে আজীবন স্ট্রেট ব্যাটেই আনইভেন দারিদ্র্যের বলগুলি খেলে যেতে পারি।
১০ লক্ষ বেসপ্রাইজের আমাকে ২০১৭র ফেব্রুয়ারিতে ২.৬০ কোটিতে এসআরএইচ দলে নিলো সেবারের আইপিএল-এ খেলাবে বলে। সেদিন তুমি বলেছিলে, ‘টাকার পাহাড়ে চড়লি এবারে, মাথাটা যেন না ঘুরে যায়, যেন সোজা থাকে।’ সেদিন আইপএল নিলামের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় তোমার কথাগুলি না ঘুরে যাওয়া মাথায় ছিল। বলেছিলাম, ‘টাকাটা পেয়ে পরিবারের জন্য একটা ভালো বাড়ি কিনতে চাই। আর হ্যাঁ, বাবাকে কোনভাবেই অটো চালাতে দেব না।’
তারপরে আজ অবধি আর তোমাকে অটো চালাতে দিইনি। আর টলি চৌকির আল-হাসনাৎ কলোনিতে এখন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ি।
আর তুমি তো জানোই যে, মামার হাত ধরে হায়দ্রাবাদ চারমিনার ক্লাবের স্প্রিংবোর্ড ছুয়ে ১৫/১১/২০১৫ তারিখে ২০১৫-১৬ মৌসুমে সৈয়দ মুস্তাক আলী টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আমার প্রথম শ্রেণীর অভিষেক হয়েছিলো কোচ কার্তিক উদুপ্পার তত্ত্বাবধানে আর পরের বছর ২০১৬-১৭ মৌসুমের রঞ্চি ট্রফিতে ৯ ম্যাচে ১৮.৯২ গড়ে ৪১ উইকেট নিয়েছিলাম আমি, হায়দ্রাবাদের হয়ে।
২০১৮র আইপিএলে আমাকে কিনে আরসিবি, এখনো আমি ওখানেই। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ২০১৭-১৮ মৌসুমের বিজয় হাজারে ট্রফিতেও ৭ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়ে আমিই ছিলাম সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। দেওধর ট্রফিতে ২০১৮-১৯ মৌসুমে ভারত ‘এ’ আর ২০১৯-২০ মৌসুমে ভারত ‘বি’ দলে ছিলাম আমি।
৪ নভেম্বর ২০১৭ সালে, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অভিষেক নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ৪ ওভারে ৫৩ রান দিয়ে পেয়েছিলাম কেন উইলিয়ামসনের উইকেট। ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারিতে নিদাহাস ট্রফি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে আর ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে ভারতীয় দলে আমাকে রাখা হয়েছিল আমাকে, কোনটাতেই খেলানো হয়নি অবশ্য। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আমার ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯ সোলে। জঘন্য পারফর্ম করে ১০ ওভারে উইকেটলেস ছিলাম, ৭৬ রান দিয়ে। ঐ সিরিজ বা তারপরে আর খেলি নি/ ডাক পাইনি।
দুবাইয়ে আরসিবি’র হয়ে আইপিএল খেলার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। ফুসফুসের অসুখে অসুস্থ তুমি ছাড়তে এসেছিলে আমাকে বিমানবন্দরে, মা আর ভাইয়ার সঙ্গে। চিন্তার কোন কারণ তখনো ছিলনা, তবু সেদিন তুমি বলেছিলে, ‘আমার শরীরের জন্য ভাববি না। আপাতত মন দিয়ে শুধু আইপিএল খেলবি। আমার মন বলছে, আইপিএল খেলে তুই সুযোগ পাবি অস্ট্রেলিয়াগামী টেস্ট টিমে, যা শুরু হতে প্রায় তিন মাস আরো। আইপিএল থেকে টেস্ট মোডে ঢুকতে ভালো করে প্রচুর প্র্যাকটিস করিস বাবা। সুযোগ পেলে দেখিয়ে দিস, একজন সাবেক অটোড্রাইভারের ছেলেও পারে দেশের জন্য কিছু করতে। তারপরে, তুই ফিরলে খুব আনন্দ করবো আমরা সবাই মিলে।’
দুবাই আইপিএল-য়ে জীবন দিয়ে বল করেছিলাম, বহুদিন পরে প্লেঅফে গিয়েছিল আরসিবি। সেখানে প্রথম কোয়ালিফায়ারেই এসআরএইচ-এর কাছে, মানে জেসন হোল্ডার আর কেন উইলিয়ামসনের কাছে হেরে বিদায়, ৬ নভেম্বরে। সে ম্যাচেও ৭ বলে ১০ রানে অপরাজিত ছিলাম আর ৪ ওভারে ২৮ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়েছিলাম, আর টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট।
২১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে কেকেআর-এর বিরুদ্ধে ৪ ওভারে ২টি মেডেনসহ ৮ রানে ৩ উইকেট নেবার পরে তোমার ফোন এল। কত কথা হলো আমাদের মধ্যে, প্রায় আধঘন্টা।জানলাম, তোমার শরীরটা ঠিকঠাক সুরে বাজছে না। জানো বাবা, আইপিএল-য়ে এখন ৩৫ ম্যাচে ৩৯ উইকেট আমার।হয়ত এইসব মিলিয়েই এরই মধ্যে, এল সেই স্বপ্নের তারিখটা, ২৬ অক্টোবর ২০২০। সেদিনই তোমাকে তৃপ্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়াগামী ভারতীয় টেস্ট টিমে নির্বাচিত হলাম। টিম রওনা হবে ১৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখে।
কিন্তু তোমার জন্য ভাবনাটা নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছিল না কিছুতেই, কেননা ততদিনে তোমার ফুসফুস অনেকটা ভোগাচ্ছিল তোমাকে। ৬ নভেম্বরে আইপিএল থেকে বিদায়ের পরে কিছুদিন গ্যাপ ছিল। কিন্তু বাড়ি আসা গেলনা কোভিড ১৯ জনিত প্রটোকলের কারণে। দুবাই থেকেই সিডনি পৌঁছে গেলাম ১৮ই নভেম্বর ২০২০ তারিখে। তারপরে বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইনে, সেখানেই ব্ল্যাকটাউন ওভালে প্র্যাকটিস।
২০ নভেম্বর ২০২০ তারিখে প্র্যাকটিস সেরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি, ভাইয়ার ফোন এল সেই ফুসফুসের অসুখেই তোমার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার খবর নিয়ে। উথাল পাথাল মন, দেশে ফেরার উপায় নেই কোভিড কড়াকড়ির জন্য, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবেনা (একবার ভারতে ফিরে এলে আর খেলা হতনা অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়ে), কি করে এ অবস্থায় নিজেকে সামলে খেলায় মনোনিবেশ করব! আসরে নেমে ওই মানসিক অবস্থায় নিজেকে সামলে আমাকে সামলালেন মা।
অস্ট্রেলিয়াতে থেকে গিয়ে টেস্টে দারুণ পারফর্ম করে বাবার অতৃপ্ত ইচ্ছেটা পূর্ণ করাটাই ফোকাস করতে বললেন মা। তখনো জানি না, আদৌ সুযোগ পাব কিনা টেস্টে! অত:পর সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবার শেষকৃত্যে না আসার জন্য। থেকে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়, যেহেতু তুমি চাইতে যে খেলে দেশের মুখ একদিন উজ্জ্বল করব আমি। ২৪ টা দিন ওভাবে কি করে কাটালাম, আমি ছাড়া আর কেউ জানেন না। চোখে জল আসত যখন তখন, সামলাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতাম। ঠিক করে খেতে পারতাম না। অনুশীলনে তবু ডুবিয়ে দিতাম নিজেকে, শুধু তোমার কথা ভেবে।
প্রথম টেস্টে সুযোগ হলোনা অ্যাডিলেডে।প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েও ৩৬ অলআউটের লজ্জা গায়ে মেখে হারলো ভারত। এবং শামি ভাইয়ের কবজি ভেঙ্গে যাওয়া তাকে ছিটকে দিল মাঠের বাইরে।ফলে মেলবোর্ণে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখটা চিরস্মরণীয় হয়ে গেল আমার জীবনে। পরে শুনলাম আমি না সাইনি ভাই, কার অভিষেক হবে মেলবোর্নে – এ নিয়ে বেশ কথা চালাচালি হয়েছিল টিমের থিঙ্কট্যাঙ্কে।
টেস্ট ডেবিউ হয়ে গেল আমার ওই দিন, এমনিতে যেটা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই হয়ত ছিল না। একটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে খেলে গেলাম। প্রথম ইনিংসে ৪০ রানে ২ উইকেট আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৭ রানে ৩ উইকেট, মোট ৭৭ রানে ৫ উইকেট এল আমার বলে, অভিষেক টেস্টে আর ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে নিল আমার ভারত। প্রথম ইনিংসে প্রথম ওভারে বল করার সময়ে আমার আর ব্যাটসম্যানের মধ্যে যেন তোমাকেই দেখছিলাম সজল চোখে।
ওইভাবে বল করা যায়, বলো? তারপরে তুমিই অবস্থাটা বুঝে জায়গা বদলে আমার হাতে-বলে নিজেকে যেন মেখে নিলে। আমি না, আসলে তারপর থেকে পুরো সিরিজটা তুমিই বল করে গেছো আমার ছদ্মবেশে, ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড সব গিয়ারে।যা বুঝতে গিয়ে কাদায় পড়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার তাবড় তাবড় ব্যাট।এই টেস্টেই কাফ মাসলের চোট টিমের বাইরে করে দেয় উমেশ যাদবকে।
দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের ঐতিহাসিক ব্যাটিং প্রতিরোধে পরের টেস্ট ড্র হলো সিডনিতে, এই ম্যাচে ১৫৭ রানে ২ উইকেট (৬৭ রানে ১ উইকেট আর ৯০ রানে ১ উইকেট) পাই আমি। আর এ ম্যাচে চোট পেলেন বুমরাভাই, আমাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেসার। এই টেস্ট শুরুর দিন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময়ে আকাশপানে চেয়ে আমার চোখের জলের ভিডিও ভাইরাল হলো চতুর্দিকে। নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোও এখন আর একান্তে রাখা যায়না, এই ইন্টারনেট যুগে। এটা আমার মতে, দুর্ভাগ্যই।
আর ব্রিসবেনে চতুর্থ টেস্টে বুমরাভাইকে বাইরে রেখে আমাদের পেস বোলিং লাইনআপে ছিলাম আমি, শার্দুলভাই, সাইনিভাই আর নাট্টুভাই, যার মধ্যে দু’টি টেস্ট খেলা আমিই ছিলাম অভিজ্ঞতম। প্রথম ইনিংসে ৭৭ রানে এক উইকেট আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট পেলাম আমি, যা কিছুটা হলেও ভারতীয় জয়ে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিল। এই সিরিজে তিন টেস্টে ৩৮৪ রান দিয়ে ১৩ উইকেট নিয়ে তোমার ইচ্ছে অনেকটাই পূরণ করেছি হয়ত।
এই পরিসংখ্যান যেটা জানায় না, তা হল তোমার আর টিমের প্রতি তোমার ছোট ছেলের কমিটমেন্ট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট নেবার পরের দিন ১৯ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ওই টেস্ট জিতে উঠে জেতার স্মারক একটা স্টাম্প তুলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমাকেই হয়ত খুঁজছিলাম আমি বারবার।শুনেছি, এরকম অবিশ্বাস্য ২-১ সিরিজ জয়ের পরে সেদিন নাকি আনন্দে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল গোটা ভারতবর্ষ।
দেশে ফিরে বাড়িতে আসার আগে সোজা গিয়েছিলাম খৈরতাবাদে, তোমার সমাধিক্ষেত্রে, ফুল দিয়েছি আর কেঁদেছি শুধু। বাড়ি ফিরে সবার আগে আমার জন্য গর্বিত ও সহাস্য তোমাকে জড়িয়ে ধরার স্বপ্নটা এভাবে কেন মিথ্যে হয়ে অপূর্ণ রয়ে গেল বাবা? জীবন কেন এত নিষ্ঠুর হয় বাবা? কেন সে কিছু দেবার বিনিময়ে অনেকটাই কেড়ে নেয় এভাবে?
জানো বাবা, ব্রিসবেনের গাব্বা স্টেডিয়ামের সেই স্মারক গোলাপী স্টাম্পটা তোমার আর মা-র ঘরে তোমার বড় ছবিটার পাশে যত্ন করে রাখা আছে। তুমি দেখতে পাচ্ছ কি বাবা? তুমি দেখতে পাচ্ছ কি বাবা, তোমার সেই ছোট্ট সিরাজই তোমার কথা রেখে তার দেশকে গর্বিত করেছে? তুমি দেখতে পাচ্ছ কি বাবা, তোমার সেই ছোট্ট সিরাজের টিম আনন্দে উন্মাদ করে দিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীকে? ক’দিন পরেই আবার চেন্নাই যেতে হবে ইংল্যান্ডকে খেলতে, এবারে আমাকে আশীর্বাদ করবে না বাবা?
জানি, এখন আর তোমার কিছুতেই কিছু যায় আসেনা। তবু, একটু চেষ্টা করে দেখো না বাবা, সব দেখতে পাবে তুমি।
ইতি,
– তোমার এখনো ছোট্ট সিরাজ।