আবাহনী ২১, মোহামেডান ২০।
উল্টোও হতে পারে। শুধু এটুকু মনে আছে, দু দলের পয়েন্ট পার্থক্য ছিলো তখন এক পয়েন্টের।
সুপার লিগে আর ম্যাচও বেশী বাকী নেই। এ অবস্থায় দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে যে জিতবে, সেই কার্যত সেবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। আবাহনীর জন্য কাজটা বেশ, বেশ কঠিন।
মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্ব, মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর কোচিং মোহামেডান দলটাকে দারুন ছন্দে রেখেছে। এদের বিপক্ষে আবাহনী জিততে পারবে?
আরেহ! জিততে হলে মাঠে তো এগারো জন খেলোয়াড় নিয়ে নামতে হবে আগে!
খেলার দু দিন আগে থেকে আবাহনী এই এগারোজনের দল দাড় করানো নিয়েই বিরাট সংকটে পড়ে গেলো। স্কোয়াডের জনা কয়েক খেলোয়াড় ইনজুরিতে, অধিনায়ক মাশরাফিসহ দু জনের মৌসুমী জ্বর, তিন জন আবার উচ্চমাধ্যমিক দেবেন বলে ছুটিতে।
ম্যাচের আগের দিন প্রিভিউ করবো বলে আবাহনী ক্লাবে গেছি। কোচ অনেকক্ষন আঙুল গুনে আবিষ্কার করলেন, জ্বরে ভুগতে থাকা মাশরাফিসহ তার হাতে আসলেই মাঠে নামানোর মতো সুস্থ খেলোয়াড় আছেন দশ জন। তাহলে?
তাহলে আবাহনী আগামীকাল খেলবে কী করে! দলটির প্রায় তরুন কোচ এক গাল হেসে বললেন,
`খেলা থেকে অবসর তো নেইনি; রেজিস্ট্রেশনটাও আছে এখনও। দরকার হলে কাল মাঠে নেমে যাবো। পারবো না, কি বলেন? ব্যাটিংটা তো কিছুটা পারি, নাকি?‘
আহ!
বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সুন্দর ব্যাটসম্যান, ঘরোয়া ক্রিকেট ও আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের বিবেচনায় ইতিহাসের পর ইতিহাস তৈরী করা ব্যাটসম্যান জিজ্ঞেস করছেন, তিনি ব্যাটিংটা একটু পারেন কি না!
হ্যা, সেই কোচ ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান, আদি বুড়ো চার্লস ব্যানারম্যানের সঙ্গী, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আশরাফুলের কাছে তিনি ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। ক্রিকইনফো লিখেছিলো-চীনা ক্রিকেটের নীল আর্মস্ট্রং। আর বাংলাদেশ বলে আমাদের ক্রিকেটীয় উত্থানপর্বের তিন নায়কের একজন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আমি এক কথায় বলি-ক্রিকেটের কলম্বাস।
কলম্বাস ভুল করেছিলেন। ভুল করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। আমিনুল ইসলাম বুলবুল কোনো ভুল করেননি। যা করেছেন, জেনেশুনে করেছেন। তবে কলম্বাসের সঙ্গে তার মিলটা হলো, একের পর এক নতুন জমিন আবিষ্কার করেছেন। একের পর এক নতুন আবাদ গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এবং বিশ্বের ক্রিকেটেও বটে।
বুলবুলকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৬ সালে। এটা একটা বিষ্ময়কর ঘটনাই বটে। আমি নিতান্ত বাগেরহাটের ছেলে। ১৯৯৬ সালে আমার ঢাকায় এসে বুলবুলের খেলা দেখাটাও প্রায় কলম্বাসসুলভ একটা ব্যাপার। আসলে এসেছিলাম বাগেরহাটের একটা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে; শিক্ষাসফর টাইপের ব্যাপার ছিলো। সেই সফর শেষ হলে বাকীরা বাড়ি ফেরত গেলো।
আমি ঢাকা থেকে গেলাম এক গ্রামতুতো সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়িতে। আবদার একটাই-ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে হবে; তখন কী ঢাকা স্টেয়িাম `বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম’ হয়েছে? মনে নেই।
নিতান্ত ঠেলাঠেলি করে একটা ম্যাচ দেখতে এলাম। এসে বুঝলাম, ভুল করেছি। আমি আজন্ম আবাহনীর সমর্থক। কিন্তু ঢুকে পড়েছি মোহামেডানের এক ম্যাচে; মোহামেডানেরই গ্যালারিতে। দাঁতে দাঁত চেপে খেলা দেখলাম। অমন ম্যাচের কিচ্ছু মনে থাকার কথা নয়। শুধু একটা ব্যাপার মনে আছে, মোহামেডানের লিকলিকে এক ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলো। আমার সেই আত্মীয় বললেন, এই ব্যাটসম্যানের নাম বুলবুল! সেই থেকে বুলবুল ভাইকে আমি `অপছন্দ’ করি।
সারাটা ক্যারিয়ার জুড়ে আবাহনীর কফিনে পেরেক ঠুকে গেছেন। আবাহনী থেকে লাখ লাখ টাকা অফার করা হলেও সাদা-কালো শিবির ছেড়ে আসেনি। ওই মোহামেডানে বসেই কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের আধুনিক যুগে উত্তরণের নায়ক।
বুলবুল ফুটবলার ছিলেন। অ্যামেচার ফুটবলার নন; রীতিমতো পেশাদার ফুটবলার। এখনও বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন, ফুটবলটা না ছাড়লে বাংলাদেশ এক অসামান্য মাঝ মাঠের তারকা পেতো। কিন্তু এক ইনজুরির কারণে ছেড়ে দিতে হলো ফুটবল।
ফুটবল ছাড়ার এক বছর পরই ক্রিকেট কলম্বাসের যাত্রা শুরু হলো। অস্ট্রেলিয়ায় বসলো ইতিহাসের প্রথম যুব বিশ্বকাপ। সেখানে আইসিসি যুব দলের হয়ে খেলতে চলে গেলেন; নতুন জমি, নতুন আবাদ। এরপর নব্বইয়ের দশক জুড়ে এই অসামান্য ব্যাটসম্যান তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে জাতীয় দলকে কী উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে টেনে এনেছেন, সে ইতিহাসের পরতে পরতে লেখা আছে। লেখা আছে আইসিসি ট্রফিতে বুলবুলের পারফরম্যান্স, লেখা আছে বুলবুলের স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ের কথা।
স্পিনটা খেলতেন প্রবল দাপটের সাথে, সেটা তার শত্তুরেও স্বীকার করবে। তবে অপবাদ ছিলো যে, জেনুইন ফাস্ট বোলিংয়ে তেমন কার্যকর নন। কিন্তু জিম্বাবুয়ের সোনালী প্রজন্মের ত্রাস পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে বুলায়েতে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে অপবাদটা টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুতেই নেদীর ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
‘কলম্বাস’ বুলবুলের সেরা কীর্তি, বলা চলে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা কীর্তি নিশ্চয়ই অভিষেক টেস্টে সেই ১৪৫ রানের ইনিংস। এই ইনিংসে কী কী রেকর্ড হয়েছিলো, কীভাবে ৮ ঘন্টা ৫০ মিনিট ধরে ব্যাটিং করে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন; সে কথা কী এই মূর্খ দেবব্রতর বলতে হবে!
বুলবুলের ইনিংসটা সম্পর্কে আমরা একটা কথাই বলতে পারি- এটা ছিলো বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রমাণের এক ইনিংস। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে চারিদিকে প্রধাণতম সমালোচনা, নিন্দা ছিলো; এই দেশটির ক্রিকেটাররা প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট অবকাঠামো ছাড়াই চলে এসেছে টেস্ট খেলতে। এবং সেটাই স্ট্যাটাসটা নাকি খেলা দিয়ে মেলেনি, মিলেছে টেবিলে। এমনকি বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের কোনো ব্যাটসম্যান চার শো রানের ইনিংস খেলে ফেলবেন, এমন সব রসিকতাও হচ্ছিলো।
এইসব নিন্দার জবাব দেওয়ার একমাত্র উপায় ছিলো মাঠে কিছু করে দেখানো। সেই দায়িত্বটা বুলবুল যে অমন করে পালন করবেন, তা কী আমরাও কল্পনা করতে পেরেছিলাম? পারিনি। কল্পনাও করতে পারিনি যে বুলবুল সেদিন ক্রিকেট ইতিহাসই নতুন করে লিখবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সটা ওই সময়েই করে দেখাবেন, যা স্পর্শ করতে আরও প্রায় অর্ধযুগ কেটে যাবে এই দেশটিরই কোনো ব্যাটসম্যানের! আবারও বুলবুল কলম্বাস হয়ে উঠলেন।
প্রথম টেস্টের নতুন জমিনে, ১৪৫ রানের নতুন আবাদ করলেন। এর আগেই ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন আমাদের কলম্বাস। সেখানেও স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তান, পাকিস্তানের বুকে নতুন জমিন বানিয়ে আবাদ করে এসেছিলেন। প্রথম কয়েকটা টেস্টের পর বুলবুল আসলেই ফর্মটা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তার ওয়ানডে বা টেস্ট ক্যারিয়ার কিছুতেই সত্যিকারের বুলবুলকে প্রতিফলিত করতে পারে না। সে জন্য নানারকম মাঠের ও মাঠের বাইরের ঘটনাও দায়ী। আজ এই দিনে সেসব আর আলোচনা না করি। শুধু বলি যে, ২০০২ সালে ৩৪ বছর বয়সে নিভৃতে শেষ হয়ে গেছে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ক্যারিয়ার। ‘বিদায়’ শব্দটাও বলার সুযোগ পাননি। আজও পর্যন্ত বুলবুল ‘অবসরপ্রাপ্ত’ ক্রিকেটার নন।
খেলা ছাড়ার পর দেশে অল্প সময়ের জন্য কোচিং করিয়েছেন। একটি করপোরেট দল থেকে শুরু করে আবাহনী। হ্যা, আজন্ম ‘শত্রু’ আবাহনীতেই এলেন। আর এসেই বাজিমাত শুরু করলেন। টানা দুই শিরোপা জিতে দিয়ে গেলেন আবাহনীকে। এরপরই ডাক পড়লো এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে। আরও কিছুদিন আবাহনীর উপদেষ্টা কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিটা মৌসুমে শিরোপা তুলে দিয়েছেন ঘরে। কয়েক বছরের মধ্যেই সে সুযোগ ফুরোলো। কারণ, বুলবুলকে হয়ে উঠতে হলো আমিন স্যাং ইয়েন!
বুলবুল চললেন চীনে। চীনে ক্রিকেট বিস্তারের অপারেশন নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই অনাবিষ্কৃত এই ভূমিতে পা রাখলেন। চীনাদের শিখালেন ব্যাট-বল দিয়ে এই এক ধরণের খেলাও খেলা চলে। সেই চীনারা বুলবুলের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজ আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখে, আজ তারা এশিয়ান গোল্ডের স্বপ্ন দেখে! বুলবুল এখানে শুধু আবাদই করেননি; পতিত জমিতে সোনও ফলিয়েছেন। সেই চীন ফুরিয়েছে। কিন্তু বুলবুলের এই দৌড়ঝাপ কমেনি।
মালয়েশিয়া, হংকং, চীন থেকে যে দৌড় শুরু হয়েছিলো; এসিসি থেকে আইসিসির কর্মকর্তা হয়ে যাওয়া বুলবুল এখন সেই দৌড় দেন এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া অবদি। আজ তাকে নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেট বিষয়ক মন্ত্রণায় বসেন বিশ্বসেরা সব সাবেক ক্রিকেটাররা। বুলবুল আজ আইসিসিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন বিশ্বকাপ জুড়ে, বুলবুল আজ বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে ঢোকেন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে! বুলবুলকে আজ আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট নীতি নির্ধারণের, তরুনদের ক্রিকেট শেখানোর কাজে ডাকে।
এসব দেখে ঈর্ষা হয় না? এসব দেখে রাগ হয় না? এসব দেখে দুঃখ হয় না?
আমার হয়। আমাদের বুলবুল আজ অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন, আমাদের বুলবুল ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র শেখান দুনিয়াকে। আর আমরা বুলবুলকেই চিনতে পারি না! আমাদের খামখেয়ালীতে বুলবুল ক্রিকেটকে বিদায় বলতে পারেননি। সেই ভুল আর শোধরানোর উপায় নেই। তবে এই ভুলটা এখনও শোধরানোর সময় আছে।
আমিও চাই বুলবুল আরও আর্ন্তজাতিক হয়ে উঠুন। বুলবুলের ভেতর দিয়ে বিশ্ব আরও চিনুক বাংলাদেশকে। তবে এই চাওয়ার পাশাপাশি জেগে ওঠে আমার স্বার্থপর স্বত্তা। যে স্বত্তা চায়; আমাদের বুলবুল আমাদের ক্রিকেটের জন্য কিছু করুন। সে করতে বুলবুলের আপত্তি নেই। যতোবার এ নিয়ে কথা হয়েছে, বলেছেন, ‘আমিও চাই।’
বুলবুল চান, আমরা চাই; শুধু ক্রিকেট বোর্ডকে চাইতে হবে। আরেকটা ভুল করতে না চাইলে যে কোনো উপায় দেশে ফেরান এই মানুষটিকে। তার মেধা, তার পরিকল্পনা যোগ্যতা, তার ক্রিকেট বোধকে ছড়িয়ে দিন দেশে। আর এসব করলে বুলবুল কতোটা সম্মানিত হবেন জানি না; বুলবুলকে ফেরাতে পারলে আমরা, বাংলাদেশ সম্মানিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
হ্যা, আমি অতি আবেগী নই। আমি জানি, বুলবুলের জাতীয় দলকে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে কোচিং করানোর মতো অভিজ্ঞতা নেই। তাই তাকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া যাবে না, এটুকু আমরা বুঝি। কিন্তু ক্রিকেটে অবদান রাখার জায়গা তো কেবল জাতীয় দল নয়। অনেক ভূমিকা আছে, যেখানে সম্মান দিয়েই ফিরিয়ে আনা সম্ভব এই মানুষটিকে। বোঝানো সম্ভব যে, আমরা অতীত ভুলিনি।
আসুন, বুলবুলকে এই সম্মানটা দেই। আসুন তাকে সম্মান দিয়ে নিজেরাই সম্মানিত হই।
আসুন, এই লোকটির নাম লিখে রাখি।